শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১৫ জানুয়ারি ২০১৭
আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলার নেতাদের কোন্দল চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সামনে সেই কোন্দল প্রকাশ করলেন নেতারা। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডি প্রিয়াংকা কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় নেতারা একে অন্যকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেন। এতে অনেকটা বিব্রত হন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার দলীয় নেতাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচনার সূত্রপাত ঘটান। পরে একে একে উপজেলার নেতাদের আক্রমণাত্মক ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে ওঠে। পরে দলীয় সাধারণ সম্পাদককের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাভার থেকে যাকে নমিনেশন দেয়া হবে তার জন্য আমরা কাজ করবো। তবে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার নাম একবছর আগে ঘোষণা দেয়া হলে, তার নেতৃত্বে আমাদের দলে ছোটখাটো যেসব ভুল-ত্রুটি রয়েছে তার সমাধান করে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো।
উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাভার উপজেলায় আসেন। আমরা মিটিং ডাকি, আপনারা আমাদের কথা শুনবেন। আমারও আপনাদের কথা শুনবো। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু কোন্দল রয়েছে, যা সংশোধন করে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবো।’
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, ‘কাদা ছড়াবেন না। ছড়ালে সবার গায়েই লাগবে। সাংগঠনিক ডিসিপ্লিন মেনে চলুন। কেউই ধোয়া তুলসি পাতা না। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। সময় সুযোগ মতো শ্বেতপত্র প্রকাশ হতে পারে। তিন বছরের যে কীর্তিকলাপ আছে তা প্রকাশ হতে পারে।’
১৯৭৩ সালের নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধামরাই উপজেলাকে উত্তর পাকিস্তান উল্লেখ করেছেন বলে মন্তব্য করে ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সাকু বলেন, ‘সেই উত্তর পাকিস্তানকে ১৯৭৫ সালের। ধীরে ধীরে পরে বেনজির আহমেদ (বর্তমান জেলা সভাপতি) আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে সংগঠিত করে তিন-চারবার নির্বাচনের পরাজিত হওয়ার পর বেনজির আহমেদকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হন এম এ মালেক। নির্বাচিত হওয়ার কয়েকমাস পর্যন্ত বেনজির এবং মালেক ভাই একসঙ্গে দলীয় প্রোগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে দুইজন দুই প্রান্তে চলে গেলেন কিন্তু এর কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না। এ নিয়ে আমরা হতাশায় ভুগছি।’
তিনি বলেন, ‘ধামরাই উপজেলায় আওয়ামী লীগসহ সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অবস্থান আগের মতো নেই। উপজেলা যুবলীগের সম্মেলন হয় না ১২ বছর ধরে। আর ছাত্রলীগের সম্মেলন হয় না ১৪ বছর ধরে। এটা কি দুই নেতার কারণেই হচ্ছে না? না আমাদের কারণে? সেটা আমরা জানি না।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সংগঠন যদি ঐক্যবদ্ধ না হয় তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কঠিন হয়ে যাবে।’ জেলা সভাপতি বেনজীর আহমেদকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের সংগঠনের মুরব্বি। আপনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রুপিং নিরসনের চেষ্টা করুন।’
সাখাওয়াত বলেন, ‘অনেক হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছে। ঘরে ঘরে চুক্তি হচ্ছে। সেই চুক্তি থেকে আপনারা বিরত থেকে আপনারা সঠিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই করুন।’
এরপর সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি করছি। রাজনীতির জন্য শ্রম, ঘাম এবং অর্থ ব্যয় করলাম কিন্তু হঠাৎ করে আপনারা (কেন্দ্রীয় নেতা) সংসদ বানিয়ে দেন। কিন্তু কেন? আপনারা কি আমাদের মতো মানুষদের চোখে দেখেন না। আমরা কি যোগ্যতার সঙ্গে রাজনীতি করি নাই?’
তিনি বলেন, ‘আমাকে দিয়ে সব কাজ করিয়েছেন আর হঠাৎ করে মুরাদ জংকে এমপি (২০০৮ সালের নির্বাচন) বানিয়ে দিলেন। মেনে নিলাম। মুরাদ জংকে এমপি বানানোর পরে আমি পাঁচ বছর কর্নার হয়ে রইলাম। এরপর আবার বানালেন এনামুর রহমানকে যাকে আমরা জানি না, চিনি না।’
হাসিনা দৌলা বলেন, ‘আপনারা কি জানেন তিনি (এনামুর রহমান) কোন সংগঠন করেছেন। আমাদের মতো মানুষকে যদি তাদের মেনে নিতে বলেন, তার আগে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলেন, তারপর যেন এসব লোক এমপি হয়। আগামীতে এমপি পদে মনোনয়ন দেয়ার আগে আপনারা ভেবে চিন্তে দেবেন। আমরা যারা বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমাদের মনে কষ্ট দিয়েন না। কষ্ট দেয়ার অধিকার আপনাদের নেই।’
আন্দোলন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলে থাকতে অনেক কষ্ট করেছি। টিয়ারগ্যাস, মার খেয়েছি, মুখের রং পুড়িয়েছি। কিন্তু কোনো সুফল পেয়েছি? আমরা সংগঠনের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চাই। যদি না করতে পারি আপনারা, আমাদের বহিষ্কার করে দেন।’
ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির বলেন, ‘ধামরাই আওয়ামী লীগে আগে দ্বন্দ্ব ছিল না কিন্তু এখন অনেক দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। এ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেললে আগামী নির্বাচনেও বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হবে।’
দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মান্নান সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তার কথামতো সংগঠন চলতো, নেতারা পদ-পদবি পেতো। আবার যখন মান্নান ভাই সংসদ সদস্য হলেন না তখন জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের পছন্দমতো নেতাকর্মীরা দলে পদ পেয়েছে। যা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়েছে যদি এ কমিটিগুলো দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে করা হয় তাতে দল শক্তিশালী হবে। আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হবে।’
উপস্থিত একজন নেতা বলেন, নবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান অনেক দুর্বল। সারা দেশে যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার সেখানে পাঁচটি ইউপিতে আমাদের ভরাডুবি হয়েছে। যদি দোহার-নবাবগঞ্জের আসন পুনরুদ্ধার করতে হয় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।
ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য এমএ মালেক বলেন, ‘ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগে বিবেদ আছে, তা সত্য। কী কারণে এ বিভেদ তা আমি বলতে চাই। উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য আমি যৌথসভা ডাকি। যাতে কয়েকজন প্রার্থীও হলো। তখন সবাই বললো বেনজির আহমেদ ও আমি যাকে বলবো তিনিই প্রার্থী হবেন। আমি বললাম না বেনজীর ভাই যাকে বললেন তিনিই প্রার্থী হবে। কয়েকদিন পরে বেনজির ভাই বললো তৃণমূলের ভোটে প্রার্থী বাচাই হবে। এতে আওয়ামী লীগ খণ্ডিত হলো শুধু দ্বিখণ্ডিত না চারভাগের তিনভাগ একদিকে আরেকভাগ অন্যদিকে।’
তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের নির্বাচনে আমি যাকে সমর্থন করলাম তিনি পেলেন ২৫২ ভোট। আর বেনজির যাকে সমর্থন করলেন তিনি (মিজান) পেলেন ১১৪ ভোট। যাতে প্রমাণিত হলো মানুষ বেনজির সাহেবের সঙ্গে নেই। এতেই দূরত্ব সৃষ্টি হলো। বিষয়টি এখানেই সীমবদ্ধ থাকেনি তৃণমূলের রেজাল্ট পাল্টিয়ে আমাকে বললেন মুন্সিগঞ্জে যেভাবে নির্বাচনে জেতার পরেও আরেকজনকে দেয়া হয়েছে। এখানে মিজানকে দেয়া হয়েছে।’
এ সময় মঞ্চ থেকে বেনজির এসব কথা বলতে নিষেধ করেন তখন এম এ মালেক বলেন, ‘এগুলো না বললেতো মানুষ বুঝবে না। এরপর তৎকালীন ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন আমাকে ফোন দিয়ে বলে উপর থেকে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। পরের দিন নেত্রীর সঙ্গে আমি দেখা করেছি তিনি আমাকে বললেন না আমি পরিবর্তন করি নাই।’
তিনি বলেন, আমি যখন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী হয়েছি তাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য বেনজির সাহেবের বাসভবনে বৈঠকও করেছি। কিন্তু তিনি বহুভাবে চেষ্টা করেছেন আমি যাতে থানা সভাপতি না হতে পারি। কিন্তু কর্মীরা আমার পক্ষে। এরপর আবার তার বাসায় বৈঠক করেছি তখন তিনি বলেছেন তুমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে পারো। এ জন্য তুমি আবুলকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে দাও। তখন আমি বললাম আমার কাছেতো এতো টাকা নাই। তখন তিনি বললেন তাহলে ১০ লাখ টাকা দাও। তখন অামি চেকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি।’
এ সময় সভায় হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এ সময় এম এ মালেক বলেন, ‘আমার কথা শেষ হলে তিনি কথা বলবেন (বেনজির)। এরপর পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে । সেখানে তার (বেনজির) প্রার্থী আমার প্রার্থীর কাছে নমিনেশনে হেরে যান। এরপরও তিনি বিরোধিতা করেন কিন্তু আমি আমার প্রার্থীকে পাশ করিয়ে আনি।’
তিনি বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকে প্রার্থী করানো হয়েছিল কিন্তু সেখানে তিনি ৩০ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। আমার পেয়ে প্রার্থী ৭৭ ভোট পান। আরেক জায়গাও আমার প্রার্থী পেয়েছেন ৯০ ভোট আর তার প্রার্থী ২৫ ভোট পান। যত জায়গায় নির্বাচন হয় তার প্রার্থী পরাজিত হয় এবং তার সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এখানে আমি কিছু করি নাই।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি আর বেনজির সাহেব একসঙ্গে মুক্তিযদ্ধে গিয়েছি, ট্রেনিং করেছি, খেয়েছি এবং যুদ্ধ করেছি। আর এখন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই কমিটির সভাপতি বেনজির আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক সাকু। তারা এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে আমার নামটা কেটে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও তালিকা আমার কাছেও আছে।’
এ সময় এম এ মালেককে এ বিষয়টি বলতে নিষেধ করা হয় মঞ্চ থেকে। কিন্তু তিনি কথা বলতে চেষ্টা করেন। এর পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাকে মাইক থেকে সরিয়ে দেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে খোলামেলা আলোচনায় আমরা বিব্রত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের পার্টি ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল, অনেক বড় পরিবার। ছোট-খাটো সমস্যা থাকতে পারে। পার্টির কার্যক্রম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতে পারে। যারা বক্তব্য রাখবেন, কাউকে আক্রমণ করবেন না। সমস্যা আমরা সবাই জানি। আজকের পরিবেশটা নষ্ট করবেন না। আমরা ঘরোয়া আলোচনায় সমস্যা সমাধান করতে পারি।
জেলার নেতাদের বক্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
তিনি বলেন, ‘এত ঝগড়া কেন? এত বাদানুবাদ কেন? একই পরিবারে কাজ করতে গিয়ে মতবিরোধ হয় তার সমাধান হয়। কিন্তু ঘরের ভেতর ঘর কেন? ঘরের ভেতর ঘর সহ্য করা হবে না। আপন ঘরে শত্রু হলে বাইরে শত্রুর দরকার আছে? আপন ঘরে শত্রু তৈরি করবেন না। কেউ জনগণ ও দলের ক্ষতি হয়ে দাঁড়ালে এর পরিণতি কী হয় তার প্রমাণ অতিসম্প্রতি সিরাজগঞ্জে এবং ঢাকা কলেজে নেতৃবৃন্দদের পরিণতি।’
তিনি বলেন, ‘কেউ প্রার্থী হতে পারবে না। প্রার্থী হবে নৌকা। ইতোমধ্যে কয়েকদফা যাচাই বাচাই হয়েছে। হতে থাকবে এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হবে। জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হবে না।’