গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার এক বছর পূর্তি

শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১জুলাই  ২০১৭

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার এক বছর পূর্তি

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার এক বছর পূর্তি

আজ রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারী ও রেস্তোরায় জঙ্গি হামলার ঘটনার এক বছর পূর্তি হলো ।

ওই হামলায় নিহতদের স্মরণে রেস্তোরা প্রাঙ্গণে স্থাপিত স্মৃতিমঞ্চে আজ সকালে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাড়াও সকাল থেকে একের পর এক বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠনের নেতা-কর্মী, নিহতদের পরিবারের সদস্য ও কূটনীতিকরা সেখানে যান এবং ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

ভয়াবহ জঙ্গি হামলার এক বছর পূর্তিতে গুলশানের ২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কের ওই বাড়িটিতে স্মরণ করা হলো তাদের। সেই সময় জঙ্গি হামলায় পুলিশ কর্মকর্তা ও বিদেশী নাগরিকসহ নিহত হয়েছিলেন ২২ জন।

জঙ্গি হামলার পর গুলশানের ২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে এখন নেই হলি আর্টিজান বেকারি। ভবন মালিক নিজেই থাকার জন্য বাড়িটি গোছাচ্ছেন।

জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণ অনুষ্ঠানের জন্য শনিবার কিছু সময়ের জন্য খোলা রাখা হয় ভবনটি।

এদিকে এক বছর পর নিহত পাঁচ জঙ্গি ও ওই রেস্তোরার একজন কর্মচারীর রক্ত, চুল ও শরীরের অন্যান্য অংশের ফরেনসিক ও ভিসেরা রির্পোট পুলিশের হাতে পৌঁছেছে।

হলি আর্টিজানে নিহত পাঁচ জঙ্গি হচ্ছে- নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ,মীর শামে মোবাশ্বের, খাইরুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জল এবং ওই রেস্তোরার কর্মচারী সাইফুল ইসলাম।

আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রোস্তরাঁয় হামলার এক বছরপূর্তি উপলক্ষে সেখানে স্থাপিত স্মৃতিমঞ্চে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশে জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, তবে এখনও পুরোপুরিভাবে নির্মূল হয়নি।’

এর আগে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও এনামুল হক শামীম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবে ও দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর মিকিও হাতায়েদা ওই ভবনে যান এবং ফুল দিয়ে নিহতদের স্মরণ করেন ।

সকাল ১১টার দিকে যান ঢাকায় ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমাসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

ফু দেওয়ার পর একটি শোকবাণী পাঠ করেন ইতালি দূতাবাসের কর্মকর্তা। এ সময় কয়েকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন।

ইতালিয়ান বায়িং হাউজ স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদিয়া বেনেদেতে সেদিন নিহত হয়েছিলেন। তার স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন কোম্পানির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিপুল কুমার সমাদ্দার।

পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত আইজি মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে সকাল ১১টার আগে শ্রদ্ধামঞ্চে ফুল দেয়া হয় । এ সময় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। সেদিন হামলা ঠেকাতে গিয়ে এখানে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও পরিদর্শক (ওসি) সালাউদ্দিন খান।

সকাল ১১টার পর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদল শ্রদ্ধামঞ্চে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব, বিএনপি চেয়ারপার্সনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য সায়রুল কবির খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ইতিহাস বন্ধুত্বের। সেই জায়গা থেকে কখনও ভাবিনি বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এ ঘটনা আমাদের বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে।

ফুল দেওয়ার পর একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের বলেন, যারা এই জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত তাদের দর্শন কোনো সাধারণ দর্শন নয়। তারা মওদুদীবাদ-ওহাবীবাদের সমর্থক। সেই দর্শনকে তারা ধারণ করে।

এছাড়াও শ্রদ্ধা জানান ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সেলিম রেজা নূর, আসিফ মুনীর, ডা. নুজহাত চৌধুরী, শমী কায়সার।

বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সর্ববৃহৎ এ ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ১ জুলাই, শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে। রাজধানীর গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের এ রেস্তোরায় সে সময় ৫ জঙ্গির একটি দুর্ধর্ষ দল অতর্কিত হামলা চালিয়ে রেস্তোরায় প্রবেশ করে ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০ থেকে ৩৫ জনকে জিম্মি করে রাখে এবং রাতভর হত্যাযজ্ঞ চালায়।

পরদিন শনিবার সকালে রেস্তোরায় জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। তবে এর আগে শুক্রবার রাতেই জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন।

অভিযান শেষে যৌথ বাহিনী বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত এবং মোট ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে।

নিহত ২০ জনের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশি, ১ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি ও ১ জন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন।

নিহত দুই বাংলাদেশি হলেন-ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন এবং ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। এছাড়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান অবিন্তা কবির ও ভারতীয় তরুণী তারুশি জেইনও নিহতদের মধ্যে ছিলেন। অবিন্তা কবির এলিগ্যান্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান রুবা আহম্মেদের একমাত্র মেয়ে। তিনি নিহত হওয়ার মাত্র ৪ দিন আগে ২৭ জুন বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

নিহত ইতালিয়ান ৯ নাগরিক হলেন-আদেলে পুগলিসি, মারকো তোন্দা, ক্লদিয়া মারিয়া ডি’আন্তোনা, নাদিয়া বেনেদেত্তি, ভিনসেঞ্জো ডি’আলেস্ত্রো, মারিয়া রিভোলি, ক্রিস্তিয়ান রসি, ক্লদিয়া কাপেলি ও সিমোনা মন্তি। নিহত ৭ জাপানি নাগরিক হলেন-নাকা হিরোশি, সাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই, হাসিমাতো হিদেকো ও কোয়ো ওগাসাওয়ার।

এ ঘটনায় সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে দু’দিনের শোক ঘোষণা করেছিলেন। এ ধরনের অতর্কিত হামলা চালিয়ে মানুষজনকে জিম্মি করার ঘটনা বাংলাদেশে সেটিই ছিল প্রথম।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেন, ‘শিগগিরই গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার নির্ভুল ও নিখুঁত অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে।’

এ হামলা ও হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

এ ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত অনেকটাই এগিয়েছে। নিহত ২০ জনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে গত ১৯ জুন আমরা হাতে পেয়েছি।’

 

Related posts