শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম। ১৭ মার্চ ২০১৬
দাঙ্গা আর দেশভাগ, বিতাড়ন আর জবরদখল, হিংসা আর চক্রান্তের ওপর যে রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়েছিল তার নৈতিক সংকট অনিবার্য। এই বাস্তবতার মুখে পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর বাঙালি-বৈরী রাজনীতিকে মুখোমুখি মোকাবিলা করেছেন বঙ্গবন্ধু। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলে নেপথ্যে এবং আপসের চাতুরির ওপর ভিত্তি করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হেনেছেন সরাসরি। তিনিই পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমজনতাকে সম্পৃক্ত করলেন, মূলধারার রাজনীতিকে রাহুমুক্ত করে নিয়ে এলেন জনতার কাতারে। ছয়দফা তাঁর রাজনৈতিক সনদ, ঐক্যবদ্ধ জনতা তাঁর সৈনিক, আর মানুষের সংগ্রামী চেতনা তাঁর এগিয়ে চলার প্রেরণা।
শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ছয়দফা ঘোষণার পর থেকে একদিকে পাকিস্তানি শাসকচক্রের নির্যাতনে লাঞ্ছনায় তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের ত্যাগী সাহসী সংগ্রামী নেতার অদ্বিতীয় ভাবমূর্তি অর্জন করেছেন আর অন্যদিকে এরকম এক নেতাকে সামনে পেয়ে বিভক্ত অলস কলহপ্রবণ এক জাতির বিস্ময়কর বিপ্লবী রূপান্তর ঘটেছিল দ্রুত। তারা এক নেতার পেছনে স্বাধীনতার এক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সকল ভীরুতা ও দোলাচল ঝেড়ে হয়ে উঠেছিল সাহসী এবং দেশ ও জাতির জন্যে আত্মত্যাগের মহৎ প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিল। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ সমগ্র জাতিকে সেদিন দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, এক লক্ষ্যে উজ্জীবিত করেছিল আর প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ ভাষণ যেন জিয়নকাঠি, একটি সুপ্ত সনাতন জাতিকে ত্যাগী বিপ্লবী জাতিতে রূপান্তরিত করেছিল। এমন ঘটনা বাংলার ইতিহাসে তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসে কি কখনও ঘটেছে? ঘটে নি। তাই বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সেরা জাতীয় নেতা তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে সহজে এমন মানুষের দেখা মেলে না।
তাঁকে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ থেকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় উঠে এসেছিলেন অনেক নেতা। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে উঠতি শিক্ষিত বাঙালি আর গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের নিজের দল। ধর্মবর্ণ অঞ্চল নারী-পুরুষ সব রকম ভেদাভেদ ভুলে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে মুক্তিকামী বাঙালির প্লাটফর্ম। ১৯৬৬ থেকে সৃষ্ট গণজোয়ারের মূল স্রোতস্বিনীর নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সবাইকে নিয়ে যে নৌকা তাতে ভেসেছিল তার নাম আওয়ামী লীগ, আর এর কাণ্ডারী ছিলেন মুজিব। তাই ১৯৭০ সনের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এদেশে দুটি ব্যতীত সকল আসনে বিজয়ী হয়। আর ১৯৭১ সনেও তাঁর অনুপস্থিতিতেও তাঁরই নেতৃত্ব বহাল থাকল। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু জয়ধ্বনি দিয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে।
এমন মহৎ মানুষের মন হয় শিশুর মত সরল, ব্যক্তিত্ব হয় সহজ, চালচলন অনাড়ম্বর। তাঁর ঔদার্যের সুযোগ নিয়েছে চক্রান্তকারী, আর তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি ও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত দেখে পরাজিত শত্রুর দল মরিয়া হয়ে উঠেছিল প্রত্যাঘাত হানতে। ১৯৭৫ সনের মধ্য আগস্টে শত্রু ও চক্রান্তকারীর দল তাঁকে হত্যা করে, শিশু-নারীসহ পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল আধুনিক মানবিক বাংলাদেশের জয়যাত্রা। তারপর আঁধিগ্রস্ত বন্ধুর পথে চলতে হয়েছে দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে। পশ্চাৎপদতার বিকার আর অন্ধ বিশ্বাসের জঙ্গি আন্দোলনে দিশাহীন হয়ে পড়েছিল মানুষ।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা তুলে নিলেন পিতার আরব্ধ কাজ। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিকে আবারও ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতাচক্র থেকে বের করে জনতার জন্যে উন্মুক্ত করার ব্রত নিলেন তিনি। ইতিমধ্যে অবশ্য ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদীরা, ২০০১-২০০৬ আমলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তারা শক্তিশালী হয়েছে, আঘাত হেনেছে প্রগতিশীল শক্তির ওপর, এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যিনি, সেই শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টাও হয়েছে। এই বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত গণমানুষের রাজনীতিকে মূলধারায় রূপান্তরের কাজটি এখন অনেক কঠিন। সেই কঠিন পথেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দিনবদলের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সেই অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকে চেনা, তাঁর রাজনীতিকে বোঝার কোনো বিকল্প নেই। আর একাজ শুরু করার ভালো সময় শৈশব, অন্তত মানুষ মুজিবের সাথে পরিচয় শুরু হতে পারে এই সময়ে। সেদিক থেকে ভালো হয়েছে তাঁর জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশুদিবস ঘোষণা করা। শিশুরা এই মহান নেতার জন্মদিন পালন করবে আনন্দ উৎসবে। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠে ওরা আঁকবে, গাইবে, আবৃত্তি করবে, মেতে উঠবে আরও নানান সৃজনশীল আনন্দময় কাজে। তারই মধ্য দিয়ে ওরা বঙ্গবন্ধুকে চিনবে, তাঁর জীবনকথা জানবে। সেই সাথে বয়স অনুযায়ী পরিচিত হবে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে, সেই ইতিহাসের অন্যান্য বীর সেনানী ও অগ্রনায়কদের জানবে।
কেবল এই সময়ে সাবধান থাকতে হবে যেন শিশুদের বড় মানুষ হওয়ার আয়োজনে ঘাটতি না থাকে। সেদিকে অনেকরকম দুর্বলতা দেখতে পাই। শিশুরা শিক্ষার নামে পরীক্ষার অর্গলে বন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন থেকে খেলাধুলা, গানবাজনা, আবৃত্তি-অভিনয়, রঙ-তুলি এবং মুক্ত অবকাশের আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজে শিশুহত্যার যে চিত্র ফুটে উঠছে তাও আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। পরিবারেও শিশু কি বাবামায়ের কাছ থেকে যথাযথ সাহচর্য পাচ্ছে? পাচ্ছে না। সমাজটা শিশুবান্ধব নেই। তাহলে এ সমাজ কীভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে? সোনার বাংলা তো ভবিষ্যতের নাগরিকরাই তৈরি করবে। তাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখলে সে কাজ ব্যাহত হবে- সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ কায়েম করতে হলে নতুন প্রজন্মকে এবং অনাগত দিনের প্রজন্মকে ধর্মীয় সহনশীলতা, উচ্চ মানবতাবোধ, গভীর দেশপ্রেম, আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চেতনা, বিশ্ববোধ, যুক্তিবাদী মননশীলতা, সমকালীন বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে সচেতনতা এবং ভবিষ্যত ভাবনায় সমৃদ্ধ হতে হবে।
ছোটবেলা থেকে এইসব সমৃদ্ধ ভাব ও চেতনা অনুশীলনের সুযোগ পেলে আজকের শিশুরা আগামী দিনে দেশ গড়ার যথার্থ সৈনিকে পরিণত হবে। তাদের হাতে রূপ পাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, আর বঙ্গবন্ধুকন্যার ডিজিটাল বাংলাদেশ।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ