শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ৯ জানুয়ারি ২০১৭
ঘুষখেকো কাস্টমস কমিশনার ড. আল আমিন প্রামাণিকের ফ্রিস্টাইলের লুটপাটে ডুবছে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা কাস্টমস হাউস। দুর্নীতিবাজ এই কাস্টমস কর্মকর্তার চরম অনিয়মে ব্যবসায়ীদের যেমন হয়রানি-ভোগান্তির শেষ নেই, তেমনি সরকারও হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ককর। এই গভীর সংকট ও সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন লুটপাট করে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক আল আমিন প্রামাণিক। তিনি শুধু রাজধানীর অভিজাত এলাকাতেই নয়, সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়ও বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে। দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও কাস্টমস কমিশনার ড. আল আমিন প্রমাণিকের দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানা গেছে। একাধিক সূত্র বলছে, দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর ধরে এই কর্মকর্তা খুলনা ভ্যাট কমিশনারেট ও মংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার হিসেবে আছেন অদৃশ্য শক্তির ইন্ধনে। এই সময়ে প্রামাণিক তার জেলা নওগাঁয়, রাজধানীর একাধিক অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট ও বাড়ি, এমনকি অস্ট্রেলিয়ায়ও নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিশাল সম্পদের পাহাড়। যদিও তার নামে বরাদ্দ আছে বনানীর কাস্টমস কোয়ার্টারে একটি ফ্ল্যাট। মংলা বন্দর নিয়মিত ব্যবহারকারী আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কনটেইনারপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কমিশনার আল আমিন প্রামাণিক। আমদানি পণ্যে অযৌক্তিক শুল্কায়ন, একই প্লান্টের মূলধনি যন্ত্রপাতির বিভাজন ও পণ্যের একাধিকবার কায়িক পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণসহ নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ আছে প্রামাণিকের বিরুদ্ধে। অযাচিত এ হয়রানির পেছনে কোটি কোটি টাকা ঘুষ-বাণিজ্য চলছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার ড. আল আমিন প্রামাণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইনকানুন মেনে কাজ করি। আইনের বাইরে কিছু করি না। ’ ঘুষ গ্রহণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি হাসি দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এদিকে মংলা বন্দর গতিশীল ও সচল রাখতে কাস্টমস কমিশনার ড. আল-আমিন প্রামাণিককে প্রত্যাহারের দাবিতে নভেম্বরে ব্যাপক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তখন সংবাদ সম্মেলনে খুলনার চেম্বার সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বন্দরের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কুচক্রী মহলের হিংস্র থাবায় তা ম্লান হতে চলেছে। ড. আল আমিন প্রামাণিক সেই ষড়যন্ত্রের পূর্ণতা দেওয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সব নিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করে কমিশনার ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছেন। মংলায় বর্তমানে স্থায়ী আদেশ নম্বর ৪৭/৯৮, শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালার প্রজ্ঞাপন ৫৭-আইন/২০০০/১৮২১/শুল্ক অনুসরণ করা হচ্ছে না। সরকার মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সুবিধা দিলেও এর বাস্তবায়ন নেই। বরং কয়েক গুণ শুল্ক আরোপ ও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। জানা গেছে, মংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার ড. আল আমিন প্রামাণিকের খামখেয়ালি মনোভাবে এনবিআরের আদেশ ‘ত্বরিত খালাস পদ্ধতি’ এখানে প্রায়ই অমান্য করা হয়। আর্থিক ক্ষতি ও হয়রানির কারণে ইতিমধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনাগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বন্দরে প্রায় দুই হাজার কনটেইনারে ২৩ হাজার ২৭২ মে. টন পণ্যের আমদানি কমেছে। বিগত বছরের তুলনায় এই চার মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। এই সংকট উত্তরণে খুলনার ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন দফতরের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৪ ডিসেম্বর এক পত্রে মংলা বন্দর রক্ষার্থে বন্দর ব্যবহারকারীদের মংলা কাস্টমস হাউসে দৈনন্দিন কাজে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে লেখা ওই পত্রে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান উল্লেখ করে লিখেছেন, সংকটটির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন না করা বা অবহেলা করা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অবাধ্যতা হিসেবে দণ্ডনীয়। চিঠিতে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানানো হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে আমদানি পণ্যের ১০ শতাংশ কায়িক পরীক্ষা করা হলেও ঘুষ আদায়ের জন্য মংলা কাস্টমস হাউসে চালানের ১০০ শতাংশ পণ্যের কায়িক পরীক্ষার নামে হয়রানি করা হয়। সম্প্রতি যশোরের নওয়াপাড়ার তিন সার ব্যবসায়ী মংলা বন্দর দিয়ে ২০ হাজার মেট্রিক টন ‘জিপসাম’ আমদানি করেন, যা সার তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। কিন্তু কাস্টমস কমিশনার ড. প্রামাণিক ওই উপকরণ দিয়ে লবণ তৈরি হয় জানিয়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠান। কুয়েট কর্তৃপক্ষ এটিকে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী জিপসাম উল্লেখ করলেও কাস্টমস কমিশনার এতে আপত্তি জানান। তিনি দ্বিতীয় দফায় আবারও ওই উপকরণ কুয়েটে পরীক্ষার জন্য পাঠান। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায়ও একই ফলাফল পাওয়া গেলে ওই পণ্য খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে জিপসামবাহী জাহাজ দুটিকে চার দিনের বদলে বন্দরে ১৭ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ফলে আমদানিকারক ও জাহাজ কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। জানা গেছে, গেল ২২ মে বি/ই নং সি-৯৮৮২ চালানে খুলনার এক ব্যবসায়ী এই বন্দর দিয়ে হিমায়িত রুই মাছ আমদানি করেন। বন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে পণ্য খালাসের সময় কাস্টমস কমিশনারের মনগড়া গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মাছের ওই চালানটি পুনরায় কায়িক পরীক্ষার নামে সব কার্টন খুলে মাছের পেট পর্যন্ত ফেঁড়ে ফেলা হয়। বারবার এই আমদানিকারককে নাজেহাল করা হলেও শেষ পর্যন্ত মাছের মধ্যে অবৈধ বা ঘোষণা-বহির্ভূত কিছু পাওয়া যায়নি। মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব সাইফুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি শুল্কায়নে এনবিআরের জারি করা নির্দেশনা অমান্য করে অতিরিক্ত শুল্কায়ন করেছেন কাস্টমস কমিশনার। একটি প্লান্টের অপরিহার্য যন্ত্রাংশ বিভাজন করে বিভিন্ন হারমোনাইজড সিস্টেম বা এইচএস কোডের আওতায় উচ্চহারে শুল্কায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি সঠিক ঘোষণাপত্র প্রদান না করার অজুহাতে চালানের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জরিমানাও করা হয়, যা একজন আমদানিকারককে আর্থিকভাবে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, গেল ২৮ আগস্ট খুলনার প্রতিষ্ঠিত শিল্প-প্রতিষ্ঠান হামাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বি/ই নং ১৬৯১০ পণ্য চালানে এইচএস কোড ৮৪৮০.৭১.০০-তে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে। কিন্তু মংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনারের নির্দেশে ওই পণ্যের চালান কায়িক পরীক্ষা করে প্রতিটি যন্ত্রাংশের আলাদা এইচএস কোড দেখিয়ে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এর মধ্যে পিপি ইন প্রিন্টার ফরম ২০৮৮ কেজি দেখিয়ে আলাদা এইচএস কোড ৩৯২০.২০.৯০-তে শ্রেণিবিন্যাস করে জোরপূর্বক ২ লাখ ৮১ হাজার টাকা অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিথ্যা ঘোষণার অজুহাতে অন্যায়ভাবে আরও তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অধিকন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এই পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু বা মূল্য কেজিতে ২ মার্কিন ডলার থাকা সত্ত্বেও ট্যারিফ মূল্য ২ দশমিক ৫০ ডলার হিসেবে শুল্কায়ন করা হয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন কাস্টমস হাউসে ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্যে রাজস্ব হয়রানি ঝুঁকির ওপর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে জরিমানা আরোপিত হলেও বিভিন্ন সময়ে মংলা কাস্টমসে শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ওপর ১০০ থেকে ১২০ শতাংশ হারে জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। মাঝে-মধ্যে আমদানি করা চাল, গম, ক্লিঙ্কার ইত্যাদি পণ্য খালাসের আগে বাধ্যতামূলক ১০০ শতাংশ কায়িক পরীক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা, যা এনবিআরের আদেশের পরিপন্থী। অভিযোগ রয়েছে, কাস্টমস কমিশনারের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে মংলা বন্দরে পাথরবাহী জাহাজ আমদানিতে আমদানিকারকরা অনীহা প্রকাশ করেছেন। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল মংলা বন্দরে এমভি ফেইয়া নামের পাথরবাহী জাহাজটি কাস্টমস জটিলতার কারণে পণ্য খালাসে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। এতে খরচের মাত্রা অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে যায়। মংলা কাস্টমসের নানাবিধ জটিলতার কারণে পাথর, ক্লিঙ্কার, সার ও কয়লাসহ অন্যান্য সাধারণ পণ্যের চালান আমদানিতে মংলা বন্দরের পরিবর্তে আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বন্দরে ৬ হাজার ৯০৫টি কনটেইনারে ৬২ হাজার ১৯৫ টন পণ্য আমদানি হলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে একই সময়ে তা কমে ৫ হাজার ১৪৫টি কনটেইনারে ৩৮ হাজার ৯২৩ টন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১ হাজার ৭৬০টি কনটেইনারে পণ্য ঘাটতি ২৩ হাজার ২৭২ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৬১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তবে নভেম্বর পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৯৩৪ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১২৭ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা।