শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬
দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার পৌনে এক লাখ শিশুর জন্য রয়েছে ৪০২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ উপজেলাতেই রয়েছে জেলার সর্বাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থেকে প্রতিনিয়ত চলছে কর্তা ব্যক্তিদের তহবিল তছরুপ। খাতা-কলমে নাম সর্বস্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেও তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখো টাকা। শিশুদের বিনা পয়সার বই বিক্রি থেকে শুরু করে উপবৃত্তির টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে এ উপজেলায়। ১০ দিন ধরে পুরো উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে চিরুনি অভিযান চালিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। হাতিয়া থেকে ফিরে এ নিয়ে তার ৮ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
একসঙ্গে একাধিক স্কুল থেকে পাস করছে হাতিয়ার চরাঞ্চলের বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা। কোথাও আবার পরীক্ষা না দিয়েও পাসের নজির রয়েছে। কারিগরি ত্রুটি কিংবা ভুলবশত নয় বরং জেনে-বুঝেই এমনটি করা হচ্ছে। নামসর্বস্ব স্কুল জাতীয়করণের জন্য এই অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিস। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখো টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিম গাবতলী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নিয়মিত পাঠদান চালিয়ে আসছে। প্রতিবছরের মতো সর্বশেষ ২০১৫ সালেও স্কুলটি থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯ শিক্ষার্থী।
এদের আবার একই বছর উত্তর পশ্চিম গাবতলী অমি স্কুল থেকেও উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এ স্কুলটির কোনো অস্তিত্বই নেই। পাসের তালিকায় আরো তিন শিক্ষার্থীকে যুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের নাম ঠিক থাকলেও পরিবর্তন করা হয়েছে শুধু রোল নম্বর।
এই ৯ শিক্ষার্থীর নাম, ঠিকানা ও পরীক্ষার রোল নম্বরসহ উপজেলা শিক্ষা অফিসের ডিআর (রেজিস্ট্রেশনভুক্তি) জাগো নিউজের হাতে রয়েছে। শিশুদের বিষয়টি চিন্তা করে তাদের নাম ও রোল নম্বর প্রকাশ করা হলো না।
তাছাড়া জাতীয়করণের জন্য প্রস্তুত প্রতিবেদনে স্কুলটির যে চারজন শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে তারা বিভিন্ন এনজিও বা বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত।
একটি স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে দুইটি সার্টিফিকেট পেয়ে হতভম্ব শিক্ষার্থীরাও। তারা জানায়, ২০১৫ সালে তারা উত্তর পশ্চিম গাবতলি স্কুল থেকে সমাপনী পরীক্ষা দেয়। কিন্তু অন্য একটি স্কুল থেকেও ফলাফল এসেছে। অথচ তারা ওই স্কুলের নামই শোনেনি।
স্কুলটির অস্তিত্বই নেই, অথচ কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে এ স্কুলটি সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। শুধু প্যাড আর শিক্ষা অফিসের ফাইলেই আছে এই স্কুল। স্কুলটি জাতীয়করণের জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে। স্কুলের চারজন শিক্ষক নিয়োগে লাখো টাকা বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসের বিরুদ্ধে।
এদিকে, একই কায়দায় চলতি বছরও উত্তর পশ্চিম গাবতলি অমি স্কুল থেকে ১০ শিক্ষার্থী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। অথচ এ বছর স্কুলটি থেকে এই শিক্ষার্থীদের নাম সমাপনী পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন দেখানো হয়। কিন্তু তাদের কেউ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
সার্টিফিকেট জালিয়াতির এ চক্রটির অন্যতম সদস্য হিসেবে নাম উঠেছে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাসের বিরুদ্ধে। অস্তিত্বহীন স্কুল জাতীয়করণের শর্ত পূরণ করতেই তিনি এ সার্টিফিকেট জালিয়াতি করছেন।
নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এর জন্য তিনি দায় চাপান সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, প্রতিবছর কমপক্ষে ৮ হাজার শিক্ষার্থী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের সবাইকে তো চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু অভিযোগ এসেছে একজন শিক্ষার্থী তো দুই স্কুল থেকে সার্টিফিকেট পাবে না, আমারা তদন্ত করে তাকে একটি স্কুল থেকেই সার্টিফিকেট দেব। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন তো পরীক্ষা চলছে, আগামী জানুয়ারিতে আমি এসব অনিয়মের বিষয়ে ধরবো। আগে কে কী করেছে সেগুলো আমার বিষয় না। অন্তত বিশ্বাস রাখেন আমার সময়ে অনিয়ম হবে না।’
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ডিআর তালিকায় দেখা যাচ্ছে দুইটি বিদ্যালয়ে একই শিক্ষার্থীর নাম
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার কাছে হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে। একজন শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছি। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। আমার কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে আমি কঠোরভাবে সেগুলো তদন্ত করবো। এভাবে অনিয়ম হলে একটি স্কুলও জাতীয়করণ হবে না।’