শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ২৭ আগস্ট ২০১৬
গত পাঁচ করবর্ষ ধরে যে করদাতারা নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করে আসছেন এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১১ ধরনের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়া হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে এমন প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধকারীদের ১১ ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিতে সুপারিশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোড (এনবিআর)।
সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবসার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, বন্দরে বিশেষ চ্যানেল দিয়ে দ্রুত পণ্য খালাস, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা ব্যয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্লট বরাদ্দ, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটের ইউটিলিটি (গ্যাস, বিদ্যুত, পানি) সংযোগ সুবিধা এবং পরিবহনে চাহিদা অনুযায়ী টিকিট ও আসন বরাদ্দ।
এনবিআরের প্রস্তাবে আরো রয়েছে, নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত সুদ হারের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদ হারে ঋণ প্রদান, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ে বিশেষ ছাড় দেয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা দিতে সুপারিশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সারাদেশে রাজস্ববান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছি। কীভাবে বেশি রাজস্ব আহরণ করা যায় এবং কর প্রদানের বিষয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ নিচ্ছি। একই সঙ্গে রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিরও প্রয়াস চালানো হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধকারীদের বিভিন্ন সুবিধা এবং সম্মান দিয়ে থাকে। আমরাও আমাদের করদাতাদের সম্মানিত করার উদ্যোগ নিয়েছি।
করদাতাদের সম্মানিত করা হলে বাংলাদেশের কর সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, এসব সুবিধা দেওয়া হলে বাংলাদেশের কর সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। করদাতার সংখ্যা ১১ লাখ থেকে ৫০ লাখে আসতেও সময় লাগবে না।
এদিকে চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনবিআর। যা গত অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি হবে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে করদাতা ১১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৪ লাখে উন্নতি করতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্দেশ দিয়েছেন। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও করদাতার সংখ্যা বাড়াতেই এনবিআর এরূপ কৌশল নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীর মধ্যে যারা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী তাদের ট্যাক্স কার্ড দিয়ে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু অল্প আয়ের নিয়মিত করদাতাদের ভাগ্যে এ সম্মান জোটে না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তোলে, নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করে আমি কী পাচ্ছি? নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী সাধারণ আয়ের একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করা হলে তারা অবশ্যই রাজস্ব প্রদানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে। এতে অল্প সময়ে করদাতার সংখ্যা ও রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আমার মনে হয়, এনবিআরের এ প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছর থেকে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করছে এমন প্রত্যয়নপত্র এনবিআর থেকে সংগ্রহ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এনবিআরের এ প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিস বরাবর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা দেয়ার জন্য সুপারিশপত্র দেবে, যা সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিসে জমা দিতে হবে। নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিকে চাকরি পেতে এনবিআর থেকে অর্থমন্ত্রীর সই করা বিশেষ প্রত্যায়নপত্র দেয়ার কথাও প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
বর্তমানে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এনবিআর রাজস্ব কার্ড দেয়। এসব রাজস্ব কার্ডকে সিআইপি (বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) কার্ডের সমান মর্যাদা দিতে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। যদিও এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। আগের ওই প্রস্তাব সম্প্রতি পাঠানো সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়েছে, রাজস্ব কার্ডধারীদের সিআইপি কার্ডধারীদের সমান মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। সিআইপি কার্ডধারীদের মতো বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ, গণপরিবহনে প্রথম শ্রেণির আসন বরাদ্দ, সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ এবং সরকারি নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে বৈঠক করার সুযোগ দেয়ার সুপারিশ করা করেছে এনবিআর।
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে রাজস্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে। বিশেষ সুবিধা পেতে অনেকে নিজ উদ্যোগে রাজস্ব দিতে এগিয়ে আসবে। বিশেষভাবে নতুন করদাতা (তরুণ) ও নতুন প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে আগ্রহী হবে।
রাজস্ব ফাঁকিবাজরা সুবিধাবঞ্চিত হতে থাকলে এক সময় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বা বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে বাধ্য হবে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করতে। একই সঙ্গে রাজস্ব খেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধের কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা পাওয়ার পরও রাজস্ব ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে দ্রুত শাস্তির সুপারিশ করেছে এনবিআর।
রাজস্ব পরিশোধকারীদের কী ধরনের সুবিধা দেয়া উচিত তা নিয়ে এর আগে এনবিআরের আয়কর, শুল্ক ও মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বা ভ্যাট শাখা থেকে পৃথক পৃথক প্রস্তাব তৈরি করে এনবিআর চেয়ারম্যানের দফতরে জমা দেয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে এনবিআর চেয়ারমানের নেতৃত্বে তিন শাখার সদস্য চূড়ান্ত করতে প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।