শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১৬ আগস্ট ২০১৬
‘আগামীকাল রাত ৮টায় তোমরা হলি আর্টিজানে চলে এসো। আমি রেস্টুরেন্টের সামনে গ্রাউন্ডে ছাতার নিচে একটি টেবিলে থাকব’
হলি আর্টিজানে হামলার ১৬ ঘণ্টা আগেই জঙ্গি নিবরাস ইসলামকে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছিলেন বর্তমানে পুলিশ রিমান্ডে থাকা হাসনাত করিম। বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে তিনি তাকে পরদিন রাত ৮টায় গুলশানের হলি আর্টিজানে তার সহযোগীদের নিয়ে আসতে নির্দেশনা দেন। একই সময় নিবরাস ইসলামের সঙ্গে তার প্রায় ১০ মিনিট মেসেজ আদান-প্রদান হয়। যেখানে হামলা পরিচালনার আর এক মাস্টারমাইন্ড মারজান প্রসঙ্গও চলে আসে। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেট থেকেও হত্যাকাণ্ডের পর নিহতদের ছবি ও ভিডিও পাঠানোর প্রমাণও মিলেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্রটি যুগান্তরকে জানিয়েছে, হামলা সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে হাসনাত করিমের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে এসব তথ্য পাওয়ার পর তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
জানা যায়, ৩০ জুন ভোর ৪টা ১০ মিনিট থেকে ৪টা ২০ মিনিট পর্যন্ত হাসনাত করিম জঙ্গি নিবরাস ইসলামের সঙ্গে মেসেজের মাধ্যমে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান করেন। এজন্য হাসনাত করিম তার ল্যাপটপ থেকে উইকার অ্যাপস ব্যবহার করেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার অংশ হিসেবে আনকমন ইউকার অ্যাপস ব্যবহার করা হয়। সূত্রটি জানায়, তথ্য আদান-প্রদানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজে হাসনাত করিম নিবরাস ইসলামকে জানান, ‘আগামীকাল রাত ৮টায় তোমরা হলি আর্টিজানে চলে এস। আমি রেস্টুুরেন্টের সামনে গ্রাউন্ডে ছাতার নিচে একটি টেবিলে থাকব।’ ইংরেজিতে লেখা তথ্য আদান-প্রদানের একস্থানে জঙ্গি নেতা মারজানের প্রসঙ্গও আসে। এ মারজানের বিস্তারিত ঠিকানা সোমবার জানা গেলেও এর আগে তার পরিচয়ের বিষয়টি এক রকম অন্ধকারে ছিল। পুরো নাম নুরুল ইসলাম মারজান। গ্রামের বাড়ি পাবনার সদর থানায়। গতকাল রাতে তর বাবা নিজাম উদ্দিনকেও আটক করা হয়।
এদিকে গুলশান হামলায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের বিরুদ্ধে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ক্লু বেরিয়ে আসায় তদন্ত সংশ্লিষ্টরা হতবাক হলেও তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে অনেকটা আশাবাদী। বিশেষ করে এর শেকড়ের সন্ধান তারা দ্রুত বের করতে পারবেন বলে মনে করছেন। প্রসঙ্গত গুলশান হামলায় সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশন থান্ডারবোল্ডে নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে নিবরাস ইসলাম অন্যতমদের একজন। সেও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন. হাসনাত ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, মেয়ের জন্মদিন পালন করার জন্যই সে রাতে তারা হলি আর্টিজানে হাজির হয়েছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও এখন পর্যন্ত একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, হাসনাত করিম হলি আর্টিজানে হামলার পুরো বিষয়টি নিজে উপস্থিত থেকে তদারকি করেন। সময় সময়ে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনাও দেন। একপর্যায়ে অপারেশন থান্ডারবোল্ড শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি সপরিবারে নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। তার মনে করছেন, মেয়ের জন্মদিনের তারিখের বিষয়টি যদি সত্যও হয়, সেক্ষেত্রে তিনি জন্মদিনের অজুহাত দেখাতে কৌশলে এই দিনটিই বেছে নিয়েছিলেন।
সূত্রটি জানায়, অধিকতর তদন্তের অংশ হিসেবে তারা দ্বিতীয় দফায় হাসনাত করিমকে শনিবার ৮ দিনের রিমান্ডে এনেছেন। আশা করছেন, এই রিমান্ড সময়ের মধ্যে তার কাছ থেকে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন।
এদিকে ‘হাসনাত করিমই খলনায়ক’ শিরোনামে গত ৭ আগস্ট যুগান্তরে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। যেখানে ঘটনার পরদিন ভোরে (২ জুলাই) জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে হাসনাত করিম ও তার সহযোগী তাহমিদ খানের শলা-পরামর্শের এক্সক্লুসিভ দুটি ছবিও ছাপা হয়। যুগান্তরের এ বিশেষ ছবি দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রাতারাতি মামলার তদন্তে ইতিবাচক মোড় নেয়। কিন্তু মহলবিশেষ হাসনাত করিম ও তাহমিদ খানের পক্ষাবলম্বন করে যুগান্তরে প্রকাশিত ছবি ও রিপোর্টে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে।
কোনো কোনো গণমাধ্যম জঙ্গি নিবরাস ইসলামের সঙ্গে হাসনাত করিম ও তাহমিদ খানের স্বাভাবিক আলাপচারিতার শরীরি ভাষার ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টাও করেন। অনেকে টিভি টক শোতে যুগান্তরের আলোচিত ছবির সমালোচনায় সরব ছিলেন। এমনকি তদন্ত সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তাও প্রকাশ্যে সমালোচনায় নেমে পড়েন। তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ‘পত্রিকাটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখে মফিজ বনে গেলাম…।’ তবে এসব সমালোচক শনিবার থেকে অনেকটা চুপসে গেছেন। কারণ এদিন হাসনাত করিমকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এদিকে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এডিসি ছানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি তার মন্তব্য নয়। ফেসবুকে এক মহিলা এমন মন্তব্য করেছিলেন। ওই মন্তব্যের সূত্র ধরে তিনি স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন। হাসনাত করিমকে নিয়ে বর্তমানে আপনার অবস্থান কী প্রশ্নের জবাবে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রসঙ্গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রথমেই হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরদিন সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশন ‘থান্ডারবোল্টে’ সন্দেহভাজন একজনসহ ৬ জন জঙ্গি নিহত হয়। এছাড়া জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ জনকে। আহতদের মধ্যে পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শাওন নামের আরেকজন।