শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম। ৪ জুন ২০১৬
রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে ছোট-ছোট কালো ঠোঙ্গায় করে কী যেন ফেরি করছিলেন একটি মেয়ে। শিশু ভেবে ভুল করলেও বয়স তার কমও নয় আবার। হিসেবে তরুণী। প্রথম দেখায় যে কারোই ফেরিওয়ালা মনে হবে না তাকে। কারণ কানে সাদা হেডফোন, নেভি ব্লু রঙের টি-শার্ট, পায়ে কনভার্স ও পরনে জিন্স, আর কী লাগে! এতেই তো অভিজাত পরিচয়।
কাছে গিয়ে দেখা গেলো- পিঠে ব্যাগ ও গলায় ঝুলানো বাঁশের মাঝারি ঝুড়ি থেকে ছোট-ছোট ঠোঙ্গায় ভরে বাদাম ফেরি করছেন তিনি। কিন্তু ক্রেতারা তাকে ‘বিক্রেতা’ ভাবতে নারাজ! প্রত্যেকেই অবাক!
কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই নাম জানালেন তরুণী- তাহমিনা রহমান। বসয় ২৩। পরিবার ও বন্ধুরা ডাকেন ‘কথা’ নামে। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। জন্ম মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায়। এখন বসবাস ধানমন্ডিতে। বাবা হাবিবুর রহমান সাটুরিয়া হাসপাতালে চাকরি করেন; একই হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন মা আয়েশা হাবিবও। কিন্তু ২০০৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েন বাবা, এদিকে পড়াশোনা সূত্রে মেয়েকেও বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে।
উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) শেষে মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য চাপ এসেছিল। এরপরে পুরো পরিবার মালয়েশিয়ায় স্থায়ী হতে চাইলেও বেঁকে বসেন কথা। দেশের মাটিতেই কিছু একটা করার ইচ্ছে তার।
সবাই যাতে করে যেকোনো পোশাকে প্রাধান্য দেন সেই প্রবল স্বাধীনচেতা ইচ্ছা জন্মলগ্ন থেকেই। তবে প্রথমে সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু নগরীর হ্যান্ডসাম ফেরিওয়ালা তাজুল ইসলাম লিখনের (২৯) ‘ড্রিম ভ্যান’ কথার মনে-প্রাণে সাহস যুগিয়েছে। যে কারণে এক অভিজাত পরিবারের মেয়ে হয়েও লিখনের মতো যেকোনো কাজকে মহান ভেবে নগরীর রাজপথে বাদাম বিক্রি শুরু তার।
এখন ধানমন্ডির বিভিন্ন পয়েন্টে বাদাম বিক্রি করছেন স্মার্ট কথা। সাটুরিয়া থেকে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বাদাম কেনেন তিনি। বাসায় বাদামগুলো ভালোমতো ভাজাসহ বাছাই করেন। পরে দেখতে নান্দনিক কালো ঠোঙ্গায় ঢুকিয়ে ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন। এতে করে দিন শেষে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দুই থেকে আড়াইশ টাকা আয় করে ঘরে ফেরেন কথা।
যে কোনো মানুষই যেন যে কোনো কর্মকে গুরুত্ব দেন, সমানভাবে দেখেন এটাই চাওয়া কথার।
বাদাম বিক্রি প্রসঙ্গে তাহমিনা কথা বাংলানিউজকে বলেন, ভালো একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে জব (চাকরি) করতাম। জব ছেড়ে বাদাম বিক্রির পেশা নেমেছি। স্বাধীন জীবন আমার অনেক পছন্দ। সব কাজই মহান। কাজ সবসময় কাজই। কাজের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। বাদাম বিক্রি ও ট্রাভেল এজেন্সির কাজের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি! কারণ দু’টি পেশাই আমার কাছে মহান। আর এমন চিন্তা-চেতনাই মানুষকে বদলে দিতে পারে। আমাদের ছোট একটি বাংলাদেশ- এতো বড় বড় জব পাওয়া সম্ভব নয়। তাই সব হতাশা ছেড়ে যে কোনো কাজে মন দেওয়াই উত্তম।
তিনি আরও বলেন, অনেকে পণ করেন যে চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। এতে করে সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। হতাশা কাজ করে। আবার অনেকে চুরি-ডাকাতিসহ খারাপ পথ বেছে নিয়ে থাকেন। কিন্তু যে কোনো কাজে নিজেকে খুশি রাখতে পারাই ব্যক্তিগত অর্জন। আমি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেছি কিন্তু আমার ভালো লাগেনি। প্রতিদিন রোবটের মতো সময় মেনে চলা আমার জন্য কঠিন ছিল। তবে এখন নিজে কিছু একটা করছি অনেক ভালো লাগছে। বাদাম বিক্রির মধ্যেও স্বাধীনতা আছে…।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরেন কথা। এরপরে বন্ধুদের নিয়ে যেসময় আড্ডা দিতেন সেই সময়ে বাদাম বিক্রি করছেন এই তরুণী।
মেয়ে হয়ে বাদাম বিক্রি করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তাহমিনা রহমান কথা বলেন, আমি বাদাম বিক্রেতা; অনেকে বিশ্বাস করতেই চান না। কেউ কেউ প্রশ্ন করে বসেন- আমি কি কাউকে সাহায্য করতে (তহবিল সংগ্রহ) এসেছি কিনা। তখন তাদের আমি বলি- আমি নিজেকে সাহায্য করতে এসেছি, আই ওয়ান্ট টু ডু সামথিং।
তিনি আরও বলেন, বাদাম বিক্রি করে কত টাকা আয় হলো বড় কথা নয়। দেশের সব ছেলে-মেয়েদের আমার বার্তা: ‘চলো কিছু একটা করি’। অলস সময়ে বসে না থেকে দেশের সব কাজকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।