শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ২৩ আগস্ট ২০১৬
আজ আমি পুলিশের জলকামানের পানি দেখেছি, মা। কিন্তু সে পানির রং নীল নাকি বেগুনি সেটা ভাববার কোন সময় পাই নি। শুধু মনে হলো পানির অপর নাম যে জীবন, সেটা এ পানি না। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে খোলা রাস্তায় যখন তোমার মতো হাজারো মায়ের সন্তানেরা তাদের ন্যায্য, যৌক্তিক অধিকারের জন্য চিৎকার করছে তখন কি বসে থাকা যায় বলো?
রাস্তার উপরে জ্বালানো টায়ারে জ্বলন্ত আগুনের সাথে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাঁকিয়ে কেমন যেন পত পত করে উপরে উঠছিলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে তোমার এক ছেলেই শুধু না, বিশ হাজার মায়ের সন্তানেরা ‘হল চাই’ ‘হল চাই’ বলে চিৎকার করছিলো।
তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো মা? না বুঝলেও তোমাকেই বলবো এই কথাগুলো। তোমার মতো করে এমনভাবে কেউ শুনবে না আমার এ আকুতি, বেদনা আর অতৃপ্তির কথা। কারণ, তুমি তো মা। তবে তোমার সন্তানের কথা শুনে বরং তোমার কষ্টই বাড়বে।
তুমিতো জানো না, মা! ১৯৭১ সালে হাজারো সন্তান তাদের হৃদয়ের ভেতরে লুকায়িত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধে গিয়ে মায়ের কাছেই সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলো। সেই রকম গর্বিত সন্তান আমি না। তবে তাঁরা যেমন তাদের জীবনের সবচেয়ে চরম মুহূর্তে মাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলো তাদের স্বপ্নের কথা, তেমনি আমিও শুধু আমার না বলা কথা তোমাকে জানাতে চাই।
শহীদ দুলালের মা নাকি বলেছিলো সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এ দেশের শিশুরা মা-বাবার কাছে বিস্কুট চকলেট না চেয়ে চাইবে পিস্তল-রিভলবার।
সেই মায়ের হৃদয়ের চাওয়াতো পূর্ণ হয়েছে স্বাধীনতার মাধ্যমে। মাগো, তুমি তাহলে আজ বলো না, এমন এটা কথা যাতে আমাদের হলের এই স্বপ্ন পূরণ হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হাজারো তরুণের মায়ের মধ্যে একজন মা যদি বলে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ হাজারেরও বেশি সন্তান মাথা গোজার ঠাঁই পাবে। তাহলেই পূর্ণ হবে তোমার সন্তানদের হৃদয়ের চাওয়া।
আজ তোমাকে এই কথাগুলো লিখছে তোমার সেই সন্তান, যে খেলা করতে গিয়ে একটু ঘেমে গেলে তুমি ছুটে এসে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতে। এই আকুতি ভরা কথাগুলো লিখছে তোমার সেই সন্তান, যার একটু আরামে ঘুমানোর জন্য তুমি কত কষ্টই না করেছো। সেই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা আর মাতৃভূমি সমান ও সমান্তরাল। তোমার সন্তানকে তোমার মতো করে যত্নে রাখছে। মাগো! তুমি কি জানো তোমার সেই স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হয়েছে?
এখন আর স্কুলে যাওয়ার মতো তোমার হাত ধরে যাই না। তুমি তো ভাবো, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি আছে, ছেলে আমার আরামে দোতলা গাড়িতে চড়ে। মা, আমি সেই গাড়ির দোতলায় উঠা তো দূরের কথা সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েও যেতে পারিনি অনেক দিন। সত্যি বলছি, গাড়ির দরজায় বাদুরঝোলা হয়ে চলতে হয়ে, যা দেখলে তুমি ভয় পেতে। তুমি তো ভাবো তোমার ছেলে বড় হলে থাকে। কোন চিন্তা নেই। কিন্তু সত্যিই তুমি এটাও জানো না যে, সেই ভাগ্য আমাদের নেই বা হয়নি।
ঢাকা মহানগরীতে বাড়ির কোন ছোট্ট খুপরিতে বা কোন এক চিলেকোঠায় ঠাঁই। তুমি যদি জানতে তাহলে কষ্টে বুক চেপে ধরতে। তবে আজ বলছি তোমাকে এসব কথা। খাবারের কথা, চাকরি, টিউশনি তথা খরচের দায়ভার মেটানোর জন্য কি করি শুনবে? টায়ারে জালানো আগুনের কথা তোমাকে প্রথমে বলেছি না? সেই আগুন আর কালো ধোঁয়ার যে সমন্বয় সেটাই হলো আমাদের কষ্টের রুপায়ন।
এখন তুমিই বলো এত কষ্ট, যন্ত্রণা, না পাওয়া আর বঞ্ছনা তো আগুনরূপে ফুঁসে উঠতেই পারে। কি বলে তুমি সেটা ঠেকাবে বলো? তোমার সেই সন্তান আজ অনেক দিন ধরে রাস্তায় চিৎকার করছে অধিকারের স্বপ্নে। তাকে কি তুমি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে, বলো? যদি না পারো তাহলে এবার বলো না, তোমার সেই স্বপ্নের কথা।
সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ হাজারেরও বেশি সন্তান তাদের মাথা গোজার ঠাঁই পাবে। পাবে তাদের স্বপ্নের হল। চার নেতার মতো মহাপুরুষের নামে করা সেই হলই হবে ছাত্রজীবনে তাদের আবাসিক পরিচয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।