মারওয়ান বিশারা
শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম। ২৬ জুলাই ২০১৬
তুরস্ক ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে যোগদান করার পর থেকে এ পর্যন্ত সব সময় আঙ্কারাকে এই জোটে তাদের সদস্য পদের বিষয়টি উইন-উইন প্রো-পোজিশনে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। পক্ষান্তরে ন্যাটো তুরস্কের নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং ইউরো-আটলান্টিক কমিউনিটিতে দেশটির মিলন বা একত্রীকরণের ব্যাপারে অবদান রাখছে। ফলে জোটের স্বার্থ রক্ষায় তুরস্ক দায়দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ন্যাটো ও তুরস্কের মধ্যে পরস্পরের ব্যাপারে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্কের দোরগোড়ায় ইরাক ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আইসিসের উত্থানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ুণœ হওয়ার পরও তা দমন করতে ন্যাটোর অনিচ্ছা অথবা সামর্থ্যহীনতা প্রমাণিত হওয়ায় এই আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্কে গত সপ্তাহের ব্যর্থ অভ্যুত্থান মনে হচ্ছে, তুরস্ক ও ন্যাটো জোটের মধ্যকার অবিশ্বাসকে এটা আরো গভীর করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ওপর দমনাভিযান চালালে এবং গণতন্ত্রকে হেয় করলে তুরস্ককে ন্যাটো সদস্য পদের ব্যাপারে মূল্য দিতে হবে; কিন্তু মার্কিন হুঁশিয়ারিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হচ্ছে না। আমি মনে করিÑ এটা আন্তরিক বক্তব্য নয়। বিশেষভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ব্যাপারে তুরস্কের সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন মনে হচ্ছে, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের বিকৃতিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে কৌশলগত সম্পদ হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে তুরস্ককে বিব্রত করে আসছে।
১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৯৭ সালে চারটি সামরিক অভ্যুত্থান সত্ত্বেও কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটন আঙ্কারার সাথে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এমনকি ১৯৭৪ সালে তুরস্ক সাইপ্রাসে আগ্রাসন চালানোর পরও দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; কিন্তু প্রধান প্রধান পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এরদোগান প্রশাসনের অধীনে তুরস্ককে পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিকূল বা বিরোধী একটি ‘কৌশলগত বোঝা’, ‘আইন ও বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন ও ঢিলেঢালা’ অথবা ‘হঠকারী বা বেপরোয়া, আগ্রাসী মিত্র’ এবং ‘পঞ্চম কলাম’ বলে ধারণা দিচ্ছে।
এসব অভিযোগের একটিও কি সত্য?
ন্যাটোর অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ডার জেমস স্টাভ রিডিসের মতে, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনের যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ন্যাটোর প্রতিটি অভিযান বা কার্যক্রমে তুরস্কের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে : লিবিয়ায় জাহাজ ও বিমান পাঠানোসহ আফগান নিরাপত্তাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে কোয়ালিশনের কার্যক্রমে নেতৃত্বদান, জলদস্যুতা প্রতিরোধে অভিযানে অংশগ্রহণ এবং বলকানে নিরাপত্তা রক্ষায় শান্তিরক্ষী বাহিনীতে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ।’ ওয়াশিংটন ও প্যারিসের তর্জন-গর্জন ও অভিমানের বিপরীতে তুরস্কের অভিজ্ঞতায় দেখানো হয়েছে, দেশটিকে ন্যাটোর সদস্য পদের নিশ্চয়তা দেয়া হলে অভ্যন্তরীণভাবে যে যা ইচ্ছা করে তাই করতে পারে এবং বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর জন্য দীর্ঘ দিন ধরে অবদান রাখতে পারে।
অধিকন্তু স্টাভ রিডিস, যাকে হিলারি কিনটনের রানিংমেট হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছিল; তিনি বলেন, ‘তুরস্কের ইসলামিক স্টেট থেকে সিরিয়া, ইসরাইল থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয়দের তেল ও গ্যাস; মিসরে র্যাডিক্যাল ইসলাম থেকে স্থিতিশীলতার ব্যাপারে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে।’ সংক্ষেপে বলা যায়, রেকর্ড তথা বিভিন্ন নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, এরদোগান প্রশাসনের অধীনে তুরস্ক হচ্ছে, ন্যাটোর একটি বড় সম্পদ। তুরস্ক ন্যাটো জোট থেকে উপকারভোগের চেয়ে তুরস্কের কাছ থেকেই বেশি অবদান বা উপকার পেয়ে ন্যাটো জোট উপকৃত হয়েছে। এখানে ন্যাটোর চেয়ে তুরস্কের অবদানই বেশি।
জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) মনে হয়, ন্যাটোর সদস্য থাকার জন্য তাদের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী পূর্বসূরিদের চেয়েও বেশি কিছু করতে প্রবল আগ্রহী। এমনকি তারা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের জন্যও অবদান রাখতে চায়। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের এবং ন্যাটোর একটি নতুন ও বৃহত্তর ভূমিকা দেখতে চায়। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বাইরে ন্যাটোর প্রথম ‘আউট অব এরিয়া’ অপারেশনে তুরস্ক বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার কারণে সেখানে এ ধরনের হস্তক্ষেপে অবদান রাখতে চায় বলে জানায়।
তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা কী?
তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আহমদ দাভোতোগ্লু পূর্ব ইউরোপের মতোই মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনের প্রতি সমর্থনদানের আহ্বান জানান ইউরোপের প্রতি এবং দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছে, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে তুরস্ক ন্যাটোর ভেতরে একটি সম্পদ এবং প্রভাবশালী নায়কের ভূমিকা পালন করবে। অথবা মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটো সম্পৃক্ত হলে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; কিন্তু আমার মতে, ওটা তুরস্ক অথবা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য গঠনমূলক হবে না। আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসনের পরে নিশ্চিতভাবে এ ধরনের ভূমিকা রাখার প্রয়োজন নেই এবং শক্তিশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জোট যখন তুরস্ককে পদাতিক সৈন্য হিসেবে চিহ্নিত করছে, তখন এর প্রয়োজন নেই। তুরস্কের অভ্যুত্থানপ্রয়াসে নীরবতা পশ্চিমের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। ইস্তাম্বুল ও অন্যান্য তুর্কি শহরে বারবার সন্ত্রাসী হামলা সত্ত্বেও নর্থ আটলান্টিক কাউন্সিলের ভেতর থেকে তুরস্কের পক্ষে কোনো সম্মানজনক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তুরস্কের বন্ধু হওয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান মিত্ররা তুরস্কের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে কথা বলে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাকে ‘নিজের চরকায় তেল দিতে’ বলেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এতে প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে, আঙ্কারাকে জোট থেকে বরখাস্ত করা হলে কী হবে?
তুরস্ক ন্যাটো ত্যাগ করলে তাদের নিরাপত্তা সামান্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তুরস্কের বিশাল সামরিক বাহিনী রয়েছে এবং সামরিক ব্যয়ও বিপুল। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ এবং ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তা ছাড়া অন্যান্য ন্যাটো মিত্রের চেয়ে তুরস্কের সামরিক বাহিনী বড়। সত্যিকার অর্থে আঙ্কারার সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক তেমন একটা ভালো নেই। তবে কয়েক মাস ও কয়েক সপ্তাহ ধরে আঙ্কারা প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াস চালাচ্ছে এবং বিশেষভাবে ইসরাইল ও রাশিয়ার সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে তুরস্ক বারবার তার প্রতিবেশীদের প্রতি হস্তক্ষেপ না করার এবং ‘জিরো প্রবলেম’ কূটনীতির মাধ্যমে অধিকতর বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল; কিন্তু ন্যাটো এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে না। তুরস্ক ন্যাটো ত্যাগ করলে এই জোটই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রথমত, ওটা প্রভাবশালীদের সামরিক কাব হিসেবে পরিচিতি পাবেÑ যেটা প্রধানত হবে খ্রিষ্টান দেশগুলোর কাব। বাইরে যেকোনো অভিযান চালাতে গেলে এ ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে। দ্বিতীয়ত, ন্যাটোকে আরো উন্নত করা না হলে আইএসআইএলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ন্যাটোকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। তৃতীয়ত, তুরস্ককে অস্থিতিশীল করা হলে ইউরোপের জন্য এর প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। এতে আইএসআইএল শক্তিশালী হতে পারে। চতুর্থত, এতে এ অঞ্চলে রাশিয়া আরো আগ্রাসী তৎপরতা চালাতে উৎসাহী ও সাহসী হবে এবং পঞ্চমত, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তুরস্কে তাদের পাঁচটি বড় সামরিক ঘাঁটি বা সুবিধা হারাবে।
তাহলে তুরস্ক কি ন্যাটো ত্যাগ করবে?
বাস্তবিকভাবে তুরস্কের কাছে ন্যাটো অথবা ইইউ ছাড়া বিকল্প নেই। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) কোনো জোট নয়, একটি ফোরাম। ‘ব্রিকস’ও একই ধরনের। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এরদোগান প্রশাসন হতাশার কারণে ইইউ সদস্য পদ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তারা ইইউর দাবি অনুযায়ী তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করার দাবি প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিষয়টি আইনসঙ্গত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার টেলিফোনের বিষয়টি মূল্যায়ন করে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তার তুর্কি মিত্রের প্রতি এ ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করবে। একইভাবে অ্যাডমিরাল স্টার রিডিসের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলেও বাধা আসতে পারে।
সুতরাং এরদোগান যেহেতু দেশটির সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ক্ষমতাকে আরো জোরদার করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, সেহেতু তুরস্ক ও ন্যাটো একে অপরকে অব্যাহতভাবে বিব্রত করবে এবং সম্ভবত উভয় পক্ষের মধ্যে সফরবিনিময় বৃদ্ধি পাবে; তাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে এবং আইএসআইএলের বিরুদ্ধে সহযোগিতা জোরদার হবে।
লেখক : সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর :
মুহাম্মদ খায়রুল বাশার