শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১৬ আগস্ট ২০১৬
দক্ষিণ আফ্রিকায় এ কাহিনি হয়তো বহু বছর মুখে মুখে ফিরবে। মা ও মাতৃত্ব, পিতা ও পিতৃত্ব এবং সন্তানের অস্তিত্ব- আবেগ ও বাস্তবতায় মোড়ানো এসব বিষয়ে আইনে অন্ধ আদালত কিইবা মীমাংসা দিতে পারেন!
আসুন, আপনাদের একটি বাস্তব গল্প শোনাই। ১৯ বছর আগের কথা। ২৮ এপ্রিল, ১৯৯৭ সাল। কেপ টাউনের গ্রুট স্কুর হাসপাতালে জন্ম নেয় এক শিশু কন্যা। সন্তানের মুখ দেখে বাবা-মায়ের সে কি খুশি। মেয়ের নাম রাখা হলো জেফানি নার্স। ৩০ এপ্রিল বাবা-মায়ের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তাদের মেয়ে উধাও। হই চই পড়ে গেল। হুলস্থূল শুরু হলো। পুলিশ এল। তল্লাশি হলো। হাসপাতালের একটি উন্মুক্ত সুড়ঙ্গে শিশুটির কিছু কাপড়চোপড় পাওয়া গেল। কিন্তু শিশুটির হদিস মিললো না।
নবজাতকের মা সেলেস্ট নার্স জানান, নার্সের পোশাক পরা এক নারী তার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছিলেন। এর মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন, তার মেয়ে নেই। ‘কোথায় গেল, কে নিল?’ পরে যে নার্স তাকে কোলে নিয়েছিলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। তিনি বললেন, ‘শিশুটি কাঁদছিল। তাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। পরে সেখানেই রেখে কাজে চলে যাই।’ ওই নারী এ হাসপাতালেরই কর্মী।
ওই পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি শেষ। পাঁচদিন পর মেয়েকে ছাড়াই বাড়ি ফিরলেন সেলেস্টরা। মেয়ের খোঁজ-খবর চলতে লাগল। পুলিশও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। হাসপাতালে সেলেস্ট যে বেডে ছিলেন, সেখান থেকে মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় দারুণ ক্ষেপে গেলেন তার স্বামী মর্ন নার্স। স্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে সংসার ভেঙে দিলেন।
তিন দিনের মেয়ে তার কোল থেকে কেউ কেড়ে নিয়েছে, অভিমান করে স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে। একই সঙ্গে দুই আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়েন সেলেস্ট। অবশ্য কিছু দিন বাদে ভাঙা সংসার জোড়া লাগে। কিন্তু হারানো মেয়েকে তারা কখনো ভুলে যাননি। সেলেস্টের সব সময় মনে হয়, এই বুঝি ছোট্ট সোনামনি হেসে উঠছে! খেতে চাইছে। খেলছে। মেয়ের ভাবনায় দিন কাটে তার। কী করছে সে? সে কি বেঁচে আছে, না কি…? অথবা কারো হাতে পড়ে থাকলে অথবা কেউ চুরি করে বিক্রি করে দিলে, যার কাছে আছে, সে লোক মেয়ের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করছে? অনেক প্রশ্ন। একটাই স্বান্ত্বনা- যদি বেঁচে থাকে, হয়তো একদিন না একদিন তাকে পাওয়া যাবেই।
কেটে গেল ১৮ বছর। সেলেস্ট ও মর্নের দ্বিতীয় কন্যা বেশ বড় হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকলে জেফানিও এতদিনে অনেক বড় হয়েছে। এখন যদি সে এসে বলেও, ‘তুমি আমার মা। আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে।’ তাহলে সেলেস্ট কি তাকে চিনতে পারবেন? অথবা কোনোভাবে তারা জানতে পারেন, তাদের মেয়ে বেঁচে আছে, তাহলে তারা কি জেফানির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, ‘আমরা তোর বাবা-মা। তুই আমাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে।’ তা যদি ঘটে যায়, তাহলে তা হবে জীবনের সবচেয়ে বড় নাটকীয় প্রাপ্তি। হারানো সুরে বাজবে জীবনের নতুন গান।
কেপ টাউনে বাড়ির অদূরে একটি স্কুলে ভর্তি হলো ক্যাসিডি। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বলাবলি শুরু করল- ক্যাসিডির সঙ্গে স্কুলের আরেকটি মেয়ের চেহারায় দারুণ মিল। অনেকে প্রশ্ন করল, ‘এরা কি যমজ বোন?’ তাদের দুজনকে নিয়ে গুঞ্জন চলতে থাকল। এর মধ্যে ক্যাসিডি ও সেই মেয়েটির দেখা হলো। নিজেদের চেহারা দেখে নিজেরাই বিমোহিত। সত্যিই তো। তাদের চেহারায় অনেক মিল। দুজনের বয়সের ব্যবধান চার বছর। তারপরও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
এ কথা বাবাকে জানাল ক্যাসিডি। তারই স্কুলে তার মতো দেখতে আরেকটি মেয়ে আছে। মর্ন নার্স স্থির করলেন, তার সঙ্গে দেখা করার। এসব ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি কথা। সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। তবু আশার আলো দেখতে পেলেন সেলেস্ট ও মর্ন। হতেও পারে ওই মেয়েটি তাদের হারিয়ে যাওয়া জেফানি।
সত্যিই ওই মেয়েটি যদি তাদের জেফানি হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো এর আগেও কোথাও না কোথাও তার সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে থাকতে পারে। ক্যাসিডিদের বাড়ি দুই-তিন কিলোমিটার দূরে জারা (পরিবর্তিত নাম) তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। কিন্তু সবাই বলছে, জারা ও ক্যাসিডি দেখতে প্রায় একই রকম। তাহলে এ জারাই কি জেফানি? খটকা লাগল। ক্যাসিডিকে নিয়ে মর্ন নার্স একদিন জারার সঙ্গে দেখা করলেন। তার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সব ঠিকঠাক আছে। নিজের বাবা-মাকে নিয়ে খুব গর্বভরে কথা বলল জারা। তবু সন্দেহ কাটছে না মর্ন নার্সের।
জারাকে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান বলে দাবি করে মামলা ঠুকে বসলেন সেলেস্ট ও মর্ন নার্স। তারপর জারাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে হাজির। মামলার বিষয়বস্তু শুনে জারার বাবা-মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন! এ কি শুনছেন তারা! এ ঘটনা শুনে জারারও রাগ হলো। নিছক ফালতু ও পাগলামি বলে বিষয়টিকে সে উড়িয়ে দিল। তার তো বাবা-মা আছে। তারাই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, আদর করেন। তার জীবনের স্বপ্ন-আহ্লাদ পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তারাই। এখন কে না কে এসে কী বলছে, তাতে তার কি যায় আসে? ছোটবেলা থেকে যাদেরকে বাবা-মা বলে জেনে এসেছে, তাদের কাছেই সে সারা জীবন থাকতে চায়, তাদের সেবাযত্ন করতে চায়।
পুলিশ তদন্ত শুরু করল। বেরিয়ে এল কিছু গোপন তথ্য। জারার বাবা-মা ছিলেন নিঃসন্তান। হঠাৎ কোথা থেকে তারা জারাকে নিয়ে এলেন। সেই ১৮ বছর আগে। তারপর বিষয়টি যেন সবাই ভুলেই গিয়েছিল। সবার সামনে বড় হয়ে ওঠেছে জারা। প্রতিবছর তার জন্মদিনে আত্মীয়-স্বজন আসে, উৎসব হয়। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল জারা। তাকে নিয়ে তাদের যে স্বপ্ন-আশা, তা পূরণ করতে চায় সে।
স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল। জারার জন্মসনদ দেখাতে ব্যর্থ হলেন তার বাবা-মা। ওদিকে আরো বেশি আশার আলো পেলেন সেলেস্ট ও মর্ন নার্স। এবার জোর গলায় দাবি করলেন, জারাই তাদের জেফানি, ১৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তাদের মেয়ে। ঘটনায় নতুন বাঁক নিল। উভয় পক্ষের অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হলো জারার ডিএনএ পরীক্ষা করা। আর এতেই বেরিয়ে এল প্রকৃত সত্য- ক্যাসিডিরই বোন জারা। এতদিন সে অন্যদের কাছে বড় হয়েছে। তার জন্মদাতা-দাত্রী মূলত মর্ন ও সেলেস্ট নার্স।
এরপর নতুন নাটকীয়তা শুরু হলো। জেফানিকে যারা এতদিন আদর-যত্ন দিয়ে জারা করে গড়ে তুলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে জোরালো মামলা হলো। বিশেষ করে জারার মায়ের বিরুদ্ধে শিশু চুরির অভিযোগ আনা হলো। জারার মা আদালতকে বলেছিলেন, পাশের স্টেশনে এক নারী শিশুটি তার হাতে তুলে দিয়ে চলে যান। আর কখনো তাকে দেখা যায়নি। কিন্তু আদালত এ বক্তব্য মানতে নারাজ। পরিচয়হীন শিশু পেলে তার দায়িত্ব ছিল পুলিশকে জানানো, আশপাশের লোকজনকে বলা। কিন্তু এসব কিছুই করেননি জারার মা। আদালতের ভাষ্য, শিশুর পরিচয় গোপন করে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। শিশুটির প্রকৃত বাবা-মা এতদিন যে কষ্ট পেয়েছেন, তা কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন তিনি? অপ্রিয় সত্য হলেও আদালত চলে আইনের জোরে। আবেগ সেখানে কেঁদে ফেরে।
অবশেষে আদালত ১৫ আগস্ট ২০১৬-তে মামলার রায় দিলেন। এতে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় জারার নকল মায়ের ১০ বছর জেল হয়েছে। এখন জারা কি করবে? কোন দিকে যাবে? জারার সিদ্ধান্ত, সে জেফানি হলেও যাদের আদর-যত্নে বড় হয়েছে তাদের কাছেই থাকবে, নতুন ঠিকানায় নয়। মায়ের জেল হয়েছে, তাকে কি, সে এখন তার লালনপালনকারী মায়ের বাড়িতেই থাকতে চায়। যে মায়ের গর্ভে সে জন্ম নিয়েছে, সেই মাকেও সে বাদ দিতে চায় না, তার বায়োলজিক্যাল বাবাকেও না। জেফানির বাবা-মা আশায় বুক বেঁধে আছেন, হয়তো আপন ঘরে ফিরবে তাদের মেয়ে।