শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১২ এপ্রিল ২০১৭
মোঃ আল আমিন, মাধবদী (নরসিংদী) সংবাদদাতা ঃ
পবিত্র কোরআন শরিফের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের মাধবদীর পাঁচদোনার বাড়িটি উদ্বোধনের অপেক্ষায়। গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এ বাড়ীর সংস্কারে কাজ শুরু করে ঐতিহ্য অন্বেষণ। ইতোমধ্যে সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। অবৈধ দখলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘর। চলতি এপ্রিল মাসেই উদ্বোধনের কথা রয়েছে সংস্কার করা এ বাড়ি ও নবনির্মিত জাদুঘরের। বাড়িটি সাজানো হয়েছে ব্রিটিশ আমলের কাঠ ও আসবাবপত্র দিয়ে। মূল কাঠামোর সংস্কার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ইট, চুন, সুড়কি ও যশোরের টালি। উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় তৈরি বিশেষ আয়তনের ইটের ব্যবহারেরও দেখা মিলবে এ বাড়িটিতে। বাড়িটি সংস্কারের পর ফিরেছে তার আদি পুরনো চেহারায়। পবিত্র কোরআন শরীফের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদকারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়নের পাঁচদোনা গ্রামের আরেক কৃতি পুরুষ দেওয়ান দর্পনারায়নের বংশে ১৮৩৪ সালে জন্ম গ্রহন করেন এবং ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মৃত্যু বরন করেন। গিরিশচন্দ্র সেন পরিচিতি শীর্ষক এক সংকলন থেকে জানা যায় সুদীর্ঘ ৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৮৮৬ সালে গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র কোরআন শরীফ বাংলায় অনুবাদ করে তা প্রকাশ করেন। তৎকালীন আরবী শিক্ষক, মৌলভী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন গিরিশচন্দ্র সেনকে মাওলানা রূপে আখ্যায়িত করেন। মাওলানা গিরিশচন্দ্র সেনের পিতা মাধব রায় সেন ছিলেন নবাব আলীবর্দী খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশধর। গিরিশচন্দ্র সেন ৩ ভাই, ২ বোনের মধ্যে ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। তাঁর বয়স যখন ১০ বছর তখন তাঁর পিতা মাধব রায় সেন মারা যান। নরসিংদী সদর উপজেলার মেহের পাড়া ইউনিয়নের পাঁচদোনায় ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের শতবর্ষী বাড়িটি সংস্কারের অভাবে আর দখলদারিত্বের চাপে তার পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। ২০০৮ সালে বাড়িটির মূল কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে সংস্কারে অনুদান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে ভারতীয় হাইকমিশন। পরে ২০১৫ সালে নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের মধ্যে বাড়িটি সংরক্ষণ ও একটি প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘর নির্মাণের চুক্তি হয়। এরপর সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও দিক নির্দেশনায় সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদানও পায় ঐতিহ্য অন্বেষণ। আর এ অনুদানের টাকায় এ বছরের এপ্রিলে এসে শেষ হয়েছে সংস্কার ও জাদুঘর নির্মাণের কাজ। ঐতিহ্য অন্বেষণ সূত্রে জানা গেছে, মূল অবকাঠামো অক্ষুন্ন রেখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মেরামত ও সংরক্ষণের এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা ব্রিটিশ আমলের মূল্যবান কাঠ, আসবাবপত্র ও যশোরের টালি। এ ছাড়া, ঐতিহ্য অন্বেষণের নিজ উদ্যোগে নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় তৈরি করা একটি বিশেষ আয়তনের ইটও ব্যবহার করা হয়েছে। পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি গিরিশ চন্দ্রের বাড়িতে তৈরি করা হয়েছে একটি জাদুঘর। এখানে তুলে ধরা হয়েছে গিরিশ চন্দ্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও তার লেখা বই। বাড়ির সামনে বসানো হয়েছে গিরিশচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ আবক্ষ মূর্তি। ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ‘গিরিশচন্দ্রের বাড়িটির মূল অবকাঠামো অক্ষুন্ন রাখতে প্রথমে ডকুমেন্টেশন করা হয়। পরে সে নকশা অনুযায়ী নওগাঁ ও কুড়িগ্রামের পুরাকীর্তির কাজে অভিজ্ঞ ২০/২৫ জন শ্রমিককে কাজে লাগানো হয়। তারা পরম মমতায় শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলছেন হারিয়ে যেতে বসা গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ির ঐতিহ্য।’ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, কোনও রড-সিমেন্ট ব্যবহার না করে শুধু ইট, চুন, সুরকি ও বালি ব্যবহার করা হয়েছে এই বাড়ির সংস্কারে। বাড়িটিতে আগে যা ছিল, এখনও ঠিক তাই থাকছে। তিনি আরো জানান, ‘এরই মধ্যে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এ মাসের মধ্যেই বাড়ি ও জাদুঘরটি উদ্বোধন ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।’ মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে সংরক্ষণের কাজ করায় সময় একটু বেশি লেগেছে বলে জানান তিনি। ব্যক্তিজীবনে গিরিশ চন্দ্র সেন একাধারে সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ ছিলেন। এ ছাড়া ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তিনি ‘ভাই’ খেতাবে ভূষিত হন। মাওলানা গিরিশচন্দ্র সেন আরবী, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। পবিত্র কোরআন হাদিসের প্রথম অনুবাদক হিসেবে লাভ করেন ‘মৌলভী’ খেতাব। তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক ২২ টি গ্রন্থ অনুবাদ এবং ১৩ টি নববিধান বিষয়ক ধর্ম পুস্তক রচনা করেন।