শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ২২ জানুয়ারি ২০১৭
আগে নিজের ভাষা পরে অন্য ভাষাও শিখবো আমরা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তিনি বাংলা ভাষা ব্যবহারে সকলকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শব্দের বানান ও উচ্চারণ সর্ম্পকে আরো সতর্ক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী ’৫২-এর ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসকে আরো ব্যাপকভাবে বিশ্বেরর সামনে তুলে ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহবান জানিয়ে বলেন, ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার যে অনন্য নজির তার আরো প্রচার হওয়ার দরকার। বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য মহান ত্যাগের মহিমাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের জন্য সত্যিই গর্বের বিষয়।
তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষা প্রেমীদের শুভেচ্ছা জানান।
প্রধনমন্ত্রী বলেন, ‘ইদানিং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানি না, অনেক ছেলে-মেয়ের মাঝে এখন এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না- এমন একটা ভাব।’
তিনি বলেন, ‘এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। যখন যেটা বলবে সঠিকভাবেই উচ্চারণ করবে এবং বলবে।’
শেখ হাসিনা আজ রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী ভাষণে এ কথা বলেন।
তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, আমাদের ভাষার ওপর বার বার আঘাত এসেছে। এটাকে কখনো আরবি হরফে এবং কখনো রোমান হরফে লেখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তুু বাঙালি কখনো তা মেনে নেয়নি। এটা হচ্ছে বাঙালিদের চরিত্র, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। এ জন্যই আমরা সবসময় বলি একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করার। সেভাবে আমরা স্বাধীনতাও অর্জন করেছি এই সংগ্রামের পথ বেয়ে। অন্য ভাষার প্রতি তাঁর কোনো বৈরিতা নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে, নিজের ভাষা আগে শিখতে হবে । সেই সাথে অন্য ভাষাও আমরা শিখবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অন্য ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু মাতৃভাষাকে ভুললে চলবে না। এটাই হচ্ছে আমাদের কথা। ভাষা শিক্ষার মধ্যে আলাদা একটা মাধুর্য আছে। পৃথিবীতে একমাত্র মানব জাতিরই ভাষা আছে। তারাই কেবল বলতে পারে।’
তিনি বলেন ‘আমাদের ভাইয়েরা রক্ত ও জীবন দিয়ে আমাদের এই ভাষা উপহার দিয়ে গেছেন, এর মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে’।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা প্রচলিতভাবে কথা বলতে গিয়ে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করছি সেখানে বৈচিত্র্য রয়েছে, এটা থাকবেই, এখানে উচ্চারণে আঞ্চলিকতার টানও থাকতে পারে। যেমন- আপনারা যদি জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন তাহলে আপনারা দেখবেন গোপালগঞ্জের ভাষা তিনি (বঙ্গবন্ধু) সবসময় ব্যবহার করতেন।’
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। ইউনেস্কোর ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যানভিটা অ্যাবি অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
ঢাকায় ইউনস্কো প্রতিনিধি বিট্রেস কালডুন, শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন এবং আন্তর্জাাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জিনাত ইমতিয়াজ আলী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার প্রসংগে স্মৃতিচারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার সময় কোন কোন শিক্ষকের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শব্দের ব্যবহারে আপত্তির প্রেক্ষিতে বলেন, ‘এটা স্বতঃস্ফূর্ততা, এটি সংশোধান করা যায় না। এটাই মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।
বঙ্গবন্ধুর কথা বলার ধরণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি যখন কথা বলেন, জনগণের জন্য কথা বলেন। জনগণের কাছে সহজবোধ্য ভাষাটিই উনি ব্যবহার করতেন। যার মর্মার্থ জনগণ সহজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন এবং তাদের মনে গেঁথে যাবে। যে কথাটা তাঁর জনগণের জন্য বলতে গিয়ে নিজের মন থেকে বেরিয়ে আসবে এবং জনগণের হৃদয়ে প্রোথিত হবে, সেভাবেই উনি তাঁর কথাগুলো বলতেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সে জন্য কথিত ভাষায় কথা বলবো, সেটা ঠিক আছে- কিন্তুু বাংলা ভাষার যে একটি প্রচলিত ধারা সেটাকে বিকৃতি করে ‘বাংরেজি’ যেনো না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রমিত বাংলা শব্দের বানান এবং উচ্চারণ সুনির্দিষ্ট। এখানে কোন আপোষ চলবে না। বাংলা ভাষাকে মিশ্রিত বা বিকৃত করে বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। তবে আঞ্চলিক ভাষাকে কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও বাংলা ভাষা, এর নিজস্বতা রয়েছে। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য অনুসন্ধান ও আঞ্চলিক উপ-ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
অতীতে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের ক্রু ও স্টাফদের বিরূপ উচ্চারণে বাংলা বলার দুর্বিষহ স্মৃতিও প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন।
বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসে অমর একুশে এক উজ্জ্বল এবং মহান সংযোজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একুশের পথ বেয়েই আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি।
বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এই ত্রয়ীর সঙ্গে পারষ্পরিক সম্পর্কযুক্ত, আমাদের বিজয়ের গৌরবজনক অধ্যায়ের নেপথ্যের প্রায় ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
অন্য ভাষা শিক্ষা এবং গবেষণার প্রতি প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করে বলেন, জ্ঞান পিপাসা মেটানোর জন্য অন্য ভাষা শিক্ষা প্রয়োজন। এ জন্যই তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে।
তিনি বলেন, ‘দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মাতৃভাষার সুরক্ষায় পৃথিবীর সকল ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইউনেস্কোর ৩৮তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইউনেস্কোর ‘ক্যাটাগরি-২’ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়। আমরা এ প্রতিষ্ঠানকে আরো সমৃদ্ধ করবো। এখানে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে আমরা এ বছর প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা এই পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৪ হাজার ৬৬১ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছি। পর্যায়ক্রমে সকল নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করা হবে। আমরা চাই সকল মাতৃভাষা বিকশিত হোক।
সরকার পরিবর্তননের ফলে বিএনপি-জামায়াত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ২০০১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এই ইনস্টিটিউট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও ২০০১ সাল-পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচির মতো এর নির্মাণ কাজও বন্ধ করে দেয়।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণার জন্য তাঁর সরকারের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তথ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করে আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি।’ এ প্রসঙ্গে ৯টি ভাষা শিক্ষার জন্য একটি ‘অ্যাপলিকেশন চালুর তথ্যও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামের সহযোহিতায় এবং তাঁর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রদানের বৃত্তান্তও তুলে ধরেন।