সেবা নয়, বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বারডেম হাসপাতাল

শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম। ২৫  মে  ২০১৬

সেবা নয়, বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বারডেম হাসপাতাল

সেবা নয়, বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বারডেম হাসপাতাল

সরকারি-বেসরকারি অনুদানের অর্থেই মূলত বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি। প্রতি বছরই সরকারের পক্ষ থেকে বড় অঙ্কের অনুদান দেয়া হয় হাসপাতালটিতে। অনুদান আসে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকেও। মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানিতেও পেয়ে থাকে শুল্ক সুবিধা। এসবই করা সেবামূলক উদ্দেশ্যে। কিন্তু হাসপাতালটির অভ্যন্তরীণ একটি পক্ষের কারণে মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেবামূলক থেকে বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বারডেম হাসপাতাল। সেবা নিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের মতোই মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে এখানকার রোগীদের।

গত সোমবার সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে চোখের ডাক্তার দেখাতে এসেছেন রাজধানীর মাণ্ডা এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেন। চিকিত্সকের সাক্ষাত্ পেতে তাকে পরিশোধ করতে হয় ৬০০ টাকা। চিকিত্সক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলে তাতেও মোটা অঙ্কের ফি গুনতে হয় তাকে।

দীর্ঘদিন ধরে বারডেম হাসপাতালের সেবা নিয়ে আসছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা নাজমুল আলম। তিনি জানান, এক বছর আগেও এখানে ৫০ টাকা ফি দিয়ে আউটডোর সেবা পাওয়া যেত। বর্তমানে তা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে। এটা শুধু সাধারণ চিকিত্সকদের সেবার জন্য নেয়া হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের সেবা পেতে ফি দিতে হয় আরো বেশি।

সবচেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের। গত শনিবার বারডেম হাসপাতালে ডায়বেটিস আক্রান্ত স্ত্রীকে ভর্তি করান রাজধানীর গোড়ান এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা। এজন্য ভর্তির শুরুতে ১৫ হাজার টাকা জমা দিতে হয়েছে তাকে। এছাড়া ডাবল কেবিনে অবস্থান করায় এ রোগীকে গুনতে হচ্ছে দৈনিক ২ হাজার ৪০০ টাকা। যদিও এ কেবিনে রয়েছে ছারপোকার উত্পাত।

বারডেমের মতো একটি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সেবার এমন উচ্চমূল্য কাম্য নয় বলে মনে করছেন রোগীরা। অনেকে জানান, সরকারি-বেসরকারি অনুদান পেয়ে এলেও সেবার মূল্য ঠিকই অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের মতোই নিচ্ছে বারডেম কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষার জন্য ফি নেয়া হয় ১৫০ টাকা। একই রকম ফি নেয়া হয় বারডেম হাসপাতালেও। পপুলার হাসপাতালে এ ফি ১৮০ টাকা। তবে বেসরকারি পপুলার ও মেডিনোভায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ৩০-৪০ শতাংশ কমিশন পাওয়া গেলেও বারডেমে সে সুযোগ নেই। পপুলার হাসপাতালে শয্যা ভাড়া দৈনিক ১ হাজার ৫০০ টাকা। সমপরিমাণ অর্থ গুনতে হয় বারডেমেও। দৈনিক কেবিন ভাড়া বাবদ দিতে হয় ২ হাজার ৪০০ থেকে ৭ হাজার টাকা। পপুলার হাসপাতালেও শয্যাপ্রতি ১ হাজার ৫০০ এবং কেবিনে ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়।

তবে সব রোগীর কাছ থেকে একই হারে ফি নেয়া হয় না বলে জানায় বারডেম কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের হাসপাতালে চার ধরনের রোগীকে বিভিন্ন সুযোগে সেবা দেয়া হয়। সমাজকল্যাণ কমিটির কার্ডধারী রোগীদের কেউ কেউ সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় সেবা পান। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কেউ ২৫ শতাংশ, কেউ ৫০ শতাংশ, কেউবা ৭৫ শতাংশ ছাড়ে সেবা পেয়ে থাকেন। এছাড়া ৩০ শতাংশ বিনামূল্যের শয্যা রয়েছে, যাদের পুরো চিকিত্সাসেবাই ফ্রি দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মরতরা ও তাদের পরিবার বিনামূল্যে সেবা পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ ডায়বেটিক সমিতির পরিচালক (গণমাধ্যম) ফরিদ কবির এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, হাসপাতালে আসা প্রত্যেক রোগীকে ১০০ টাকার বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করানো হচ্ছে। যদিও রোগীর জন্য চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র, পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্যশিক্ষার পরামর্শ, রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষাসহ ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা। প্রত্যেক রোগীর পেছনে তারা ১ হাজার ২০০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন। এসব সুবিধা দিতে গিয়ে প্রতি বছর ৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি দিচ্ছে বলে দাবি করলেও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। সংস্থাটির ২০১৪-১৫ অর্থবছরের আর্থিক চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই বছর সমিতি আয় করেছে ৩৯৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৩৮০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ফলে উদ্বৃত্ত ছিল ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ওই বছর শুধু বারডেমেরই আয় ছিল ১৫০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর ব্যয় ১৪২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

জানা গেছে, রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বারডেম হাসপাতালটি সরকারি জমিতে নির্মিত। সেগুনবাগিচার হাসপাতালটিও মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর বারডেম হাসপাতালের জন্য ২৫ কোটি টাকা সরকার অনুদান দেয়। এছাড়া বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তি এখানে অনুদান দিয়ে থাকেন। রাজধানীর গুলশান এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কয়েক বছর আগে বারডেম হাসপাতালে প্রায় কোটি টাকায় একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স অনুদান দেন। এছাড়া তিনি তার পুরান ঢাকার ওয়ারীতে একটি আটতলা বাড়ি ডায়াবেটিক সমিতিকে দান করেন। সেখানে বর্তমানে ডায়বেটিক সমিতির একটি হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে।

বারডেম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহিদুল হক মল্লিক বলেন, সরকার প্রতি বছর ২৫ কোটি টাকা অনুদান দিলেও তা থেকে ১৬ কোটি টাকা তাদের হাসপাতাল পেয়ে থাকে। অবশিষ্ট টাকা ডায়বেটিক সমিতির অন্যান্য হাসপাতালে ব্যয় হয়। বর্তমানে বেসরকারি অনুদানও কমে এসেছে। এছাড়া তাদের সমাজকল্যাণ কমিটির অধীনে ৬৯ হাজার কার্ডধারী রোগী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন ধরনের সহজ সেবা পেয়ে থাকেন। ফি সরকারি হাসপাতালের চেয়ে একটু বেশি হলেও উন্নত সেবার কারণে এ হাসপাতালে সার্বক্ষণিক রোগীর ভিড় থাকে।

ডায়াবেটিক সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স নির্মাণের জন্য শহীদ খালেক-মেজর সালেক বীর উত্তম ট্রাস্ট থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা অনুদান পাওয়া গেছে। এছাড়া অনুদান হিসেবে সংস্থাটিকে ইসমাইল ফ্যামিলি চ্যারিটেবল ফান্ড দিয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ২৯ হাজার ১৫২ টাকা। ইনসুলিন অনুদান পাওয়া গেছে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ২৮ হাজার ৫৭৬ টাকার। নভোনরডিক্স ফার্মা অনুদান দিয়েছে ৮২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় অনুদান দিয়েছে হাসপাতালটিকে। দাতাদের তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরো আছে— ইউনিয়ন গ্রুপ, রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন, পদ্মা প্রিন্টার্স, আয়েশা জাকি আমীন ট্রাস্ট, নূরুল আমিন, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, অপসোনিন ফার্মা, ইউনিক গ্রুপ, মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী প্রমুখ।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বারডেম হাসপাতাল তৈরির সময় স্বল্পমূল্যে রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য নিয়ম-কানুন চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালের কলেবর বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে খরচও। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি বেতন কাঠামো অনুসরণ করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের ব্যয় বেড়ে গেছে। কার্ডিয়াক ও মেডিকেল কলেজে আয় হলেও মিরপুরে হাসপাতাল করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা ঋণ নিতে হয়েছে।

ডায়াবেটিক সমিতির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বারডেমে গরিব রোগীদের চিকিত্সায় ব্যয় করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের যুগ্ম সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব। তিনি বলেন, সরকারের অনুদান সীমিত। অথচ এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা শতভাগ সরকারি স্কেলে দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনুদান এলেও তারা নগদ অর্থ না দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিংবা ভবন নির্মাণসামগ্রী প্রদান করছেন। ৩০ শতাংশ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিত্সার ব্যয় মেটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি সার্ভিস চার্জ ধার্য করা হয়েছে। মুনাফার টাকা কেউ ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করেন না।

উল্লেখ্য, ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সাসেবা দেয়ার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৬০ বছর আগে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহীম। শুরু থেকেই তার এ মহতী উদ্যোগে শামিল হন চিকিত্সক, সমাজকর্মী, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর শাহবাগে গড়ে ওঠে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল। সুত্র বনিক বার্তা

 

 

Related posts