শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম। ১৫ মার্চ ২০১৬
জীবনে পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য দরকার একটি সুস্থ, সবল ও সতেজ হার্ট। হৃদরোগ এবং স্ট্রোক বর্তমান বিশ্বের একনম্বর মারণব্যাধি-
লিখেছেন ডা: তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে। আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এই মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটে থাকে আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। হৃদরোগের প্রধান প্রধান ঝুঁকির কারণ বা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থাৎ কম ক্যালরিযুক্ত সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ধূমপান বর্জনের মাধ্যমে আমরা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে পারি এবং সেই সাথে হার্টের বার্ধক্যের গতিকে করতে পারি বিলম্বিত।
শারীরিক শ্রম ও হৃৎস্বাস্থ্য
অলসতা বা অপর্যাপ্ত শারীরিক শ্রম হার্টের বয়ঃবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেননা শারীরিক শ্রমহীনতার কারণেই হয় অতিরিক্ত ওজন, যা ক্রমান্বয়ে স্থূলতা বা ওবেসিটি, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। হার্ট হচ্ছে একটি হৃৎপিণ্ড যাকে প্রতিটি হার্টবিটের তালে তালে সঙ্কোচন-প্রসারণের মাধ্যমে সারা শরীরে সঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত রাখতে হয়। আর এ জন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত ব্যায়াম।
নিয়মিত ব্যায়ামের প্রভাব
১. হার্ট এবং মস্তিষ্ক অভিমুখী রক্তনালী বা ধমনির সরু হয়ে যাওয়া বিলম্বিত করে।
২. জমাকৃত চর্বি দহনে শরীরকে উৎসাহিত করে, যা কি না ওজন কমানো এবং স্থূলতা রোধে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. রক্তে ঐউখ বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
৪. রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রেখে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ কমায়।
৬. ধূমপান বর্জনে সহায়তা করে- ধূমপান ত্যাগ করতে পেরেছে এমন লোকজনের ওপর বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করত তাদের মধ্যে ধূমপান বর্জনের সফলতার হার দ্বিগুণ।
কায়িক পরিশ্রম আপনার সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক, যা আপনাকে অতিরিক্ত শক্তিদান করে, স্ট্রেস বা দুঃশ্চিন্তা কমায়, হাড় ও মাংসপেশিকে আরো শক্তিশালী করে এবং শারীরিক ভারসাম্য, শক্তি ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য মস্তিষ্ককে সাহায্য করে।
কোন ধরনের ব্যায়াম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?
সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনাকে এরোবিক্স, শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া এবং স্ট্রেচিং ব্যায়াম বা যোগ ব্যায়াম করতে হবে :
১. এরোবিক্স- হার্টের জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম হলো এরোবিক্স। এর মধ্যে দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাঁতার কাটা, সাইক্লিং, বাগান করা ইত্যাদি যেকোনো ব্যায়ামেই হার্ট, ফুসফুস এবং মাংসপেশির ব্যবহার হয় দীর্ঘক্ষণ ধরে। এরকম ব্যায়ামের ফলে হার্ট যেমন শক্তিশালী হয় তেমনি এতে অধিক ক্যালরি ব্যবহৃত হয়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
২. শক্তিশালীকরণ কার্যক্রম- পেট এবং পিঠের নিচের মাংসপেশির জন্য ব্যায়াম। তুলনামূলকভাবে বড় মাংসপেশিগুলো শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ায় অধিক ক্যালরি ব্যবহার করে। যেমন- সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, বাগান করা (মাটি খননকাজ) এবং পাহাড়ে ওঠা ইত্যাদি যা কি না সুস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
৩. স্ট্রেচিং ব্যায়াম বা যোগ ব্যায়াম শরীরকে নমনীয় রাখতে সাহায্য করে।
কোন ধরনের ব্যায়াম বেছে নেবেন?
সাধারণভাবে ব্যায়াম শুরু করতে হয় আস্তে আস্তে। পরে এর সময় ও তীব্রতা বাড়াতে পারবেন। ব্যায়ামের তীব্রতা সেই পর্যায় পর্যন্ত নেবেন যখন আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হবে কিন্তু আপনি কথা বলতে পারবেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট এবং শিশু-কিশোরদের জন্য প্রতিদিন ৬০ মিনিট করে ব্যায়াম করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়। যদিও বেশির ভাগ মানুষের জন্যই ব্যায়াম নিরাপদ তারপরও ব্যায়াম শুরু করার আগে ডাক্তার দেখিয়ে তার অনুমতি নিয়ে কাজ করা ভালো।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ
সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন সতেজ হার্ট। আর হার্টকে সতেজ রাখতে প্রয়োজন সুষম খাদ্য গ্রহণ। তবে সুষম খাদ্য গ্রহণই সতেজ হার্টের একমাত্র পূর্বশর্ত নয়। এর সাথে প্রয়োজন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি খাবারের সাথে গ্রহণ করছেন সেই পরিমাণ ক্যালরি কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে খরচও করতে হবে। সে কারণেই প্রয়োজন কায়িক পরিশ্রমের পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণ যার মধ্যে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকবে তাজা ফল, শাকসবজি, শস্যদানা, চর্বিবিহীন গোশত, মাছ, ডাল, কম চর্বিযুক্ত এবং চর্বিযুক্ত উপাদান, আনস্যাচুরেটেড বা অসম্পৃক্ত মার্জারিন এবং তেল যেমন- সূর্যমুখী, অলিভ, কর্ন, রেপসিড।
ধূমপানকে না বলুন
হার্টকে সতেজ রাখার জন্য ধূমপান এবং যেকোনো তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ধূমপান বর্জনের ফলে-
১. রক্তে কোলেস্টেরল এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের (খারাপ কোলেস্টেরল) পরিমাণ কমে।
২. রক্তের জমাট বাঁধা কমায় এবং এর ফলে রক্তনালী ব্লক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।
সুতরাং আপনার ধূমপান বর্জন সমাজে যেমন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে তেমনি আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে ধূমপানের ভয়াবহতা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার বার্তা।
হৃৎহিতকর জীবনের লক্ষ্যে
একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের বড় অধ্যায় হলো কিভাবে আপনি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য নিজেকে অনুপ্রাণিত করবেন।
নিচের এরকম কিছু পরামর্শ আপনাকে সাহায্য করবে
১. আপনার চাহিদানুযায়ী তথ্য খুঁজে বের করুন।
স্থানীয় হৃদরোগবিষয়ক জনকল্যাণমূলক সংস্থা থেকে হৃদরোগের ঝুঁকি ও প্রতিরোধবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
২. হৃদরোগের সম্ভাব্য ঝুঁকির ক্ষেত্র সম্পর্কে অবহিত হোন।
হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো হতে পারে পারিবারিক ইতিহাস, আপনার বিএমআই, কোমরের মাপ, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা, ধূমপান এবং অপর্যাপ্ত শারীরিক শ্রম বা অলসতা।
৩. সহজে অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামে হৃদরোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে সহজ অর্জনযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
৪. আপনার উন্নতির মাত্রা চিহ্নিত করুন।
আপনার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রম এবং এর সফলতা চিহ্নিত করুন, যা আপনাকে আরো অনুপ্রাণিত করবে।
৫. শুভাকাক্সক্ষীদের কাছাকাছি থাকুন।
আপনার চার পাশের লোকজন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রমে আপনার সাথে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অথবা আপনাকে এই নতুন কার্যক্রমের অভ্যাস চালিয়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
৬. নিজেকে নিখুঁত ভাবা ত্যাগ করুন।
যদি আপনি ব্যায়ামে অনিয়মিত হয়ে পড়েন, ধূমপানে আকৃষ্ট হন কিংবা অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হন ঠিক তখনই আরো বেশি দৃঢ় মনোবল নিয়ে হৃৎহিতকর জীবনযাপনের লক্ষ্য পথে ফিরে যান।
লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা।