শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬
আজ ৫ সেপ্টেম্বর। স্বাধীনতার সূর্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী। সৈনিক জীবনের কঠিন কর্তব্য দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত না হয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে নিয়ে এগিয়ে গেছেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। তার সে চেষ্টা সার্থক হয়েছিল।
নিরাপদে ফিরতে পেরেছিল সহযোদ্ধারা। শুধু ফিরে আসেননি আমাদের নূর মোহাম্মদ। শত্রুপক্ষের একটি মর্টারের গোলা শেষে পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল তার জীবন প্রদীপ। পরে জঙলের মধ্যে পাওয়া গেছে এই বীরশ্রেষ্ঠর নিস্তেজ দেহটি। পাকিস্তানি হায়েনারা উপড়ে ফেলেছিল তার দুইটি চোখ। দেহকে ছিন্ন-ভিন্ন করেছিল বেয়নার খোচা।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম জেনাতুননেছা। বাবা আমানত শেখ। নূর মোহাম্মদ ছিলেন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। কিন্তু অভাব অনটনের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রগতি হয়নি।
ছোটবেলায় তিনি তার বাবা-মাকে হারান। ১৯৬৯ সালে নূর মোহাম্মাদ ভর্তি হন ইপিআর বাহিনীতে (বর্তমানে বাংলাদেশে রাইফেল) তখন তার বয়স ২৩ বছর। ট্রেনিংয়ের পর তার পোস্টিং হয় দিনাজপুুর। সেখানে ছিলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। তারপর আসেন যশোর হেড কোয়ার্টারে। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সিপাহী নূর মোহাম্মাদ সৈনিক মনে নাড়া দেয় স্বাধীনতা আর স্বদেশপ্রেম। তার সচেতন বিবেক বোধ তাকে মুক্তিযুদ্ধের উদ্ধুদ্ধ করে। যশোরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ৮নং সেক্টরের অধীনে।
নূর মোহাম্মাদ প্রতিষ্ঠানিক সামরিক প্রশিক্ষণ থাকায় একটি কোম্পানির প্রধান নিযুক্ত করে যশোরের সীমান্তবর্তী গোয়ালহাটি টহলের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। মুক্তিবাহিনী বিকেলে বাধা দেয় পাক বাহিনীকে। নূর মোহাম্মদ সঙ্গে ছিলেন দুইজন সহযোদ্ধা গোয়ালহাটির দক্ষিণে ছুটিপরে অবস্থান করছিল পাক বাহিনী। তাদের উপরে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেয়া হয় এই পাক বাহিনীর অবস্থানের ওপর। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কথা বুঝে ফেলে পাক বাহিনী।
তারা তিনজন পাক বাহিনীর নজরে পড়ে যান। চান পাশে অবস্থান নেয় শত্রুসেনারা। শুরু হয় অবিরাম গুলিবর্ষণ।
নূর মোহাম্মাদ বুঝতে পারেননি তিনি তার জীবনের শেষ মুখোমুখি। নূর মোহাম্মাদ সহযোদ্ধা সিপাহী নান্নু মিয়া ও সিপাহী মোন্তফা। নান্নু হাতে হালকা মেশিনগান আর এটাই ছিল তাদের হাতে প্রধান অস্ত্র। গুলি ছুটতে ছুটতে ফিরতে থাকে তারা তিনজন। এমন সময় হঠাৎ একটি বুলেট এসে সিপাহী নান্নুর বুকে বিঁধে বেরিয়ে যায়। মাটিতে পড়ে যান নান্নু মিয়া।
এলএমজি হাতে তুলে নেন নূর মোহাম্মাদ। এক হাতে নান্নু মিয়াকে নিয়ে আর অন্য হাতে নূর মোহাম্মাদের মেশিনগান দিয়ে বের হচ্ছে অবিরাম গুলি। কারণ তিনি দলীয় অধিনায়ক। তার দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচানো। সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা। তাছাড়া তিনি ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। যেন শত্রু সৈন্যরা বুঝতে না পারেন কোন দিক থেকে কতজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে লড়ছে।
ঠিক এই সময় মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে নূর মোহাম্মাদ ডান পায়ে। পাঁ গুড়িয়ে যায়। শেষ পরিণতির কথা জেনে গেছেন নূর মোহাম্মাদ। কিন্তু দমলে চলবে না। সহযোদ্ধদের বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা করে যেতে হবে তাকে। সহযোদ্ধা মোস্তফার এক হাতে ছিল এক এলএমজি। আদেশ দিলেন অবস্থান পাল্টে শত্রুর দিকে গুলি ছুঁড়তে। সেই সঙ্গে পেছনে ফিরতে। আহত নান্নুকে সঙ্গে নিলেন তিনি। তারপর এলএমজি আবার নিলেন নূর মোহাম্মাদ নিজ হাতে।
শক্রদের ঠেকাতে থাকে সে যাতে মোস্তফা নান্নুকে সঙ্গে করে স্থল ঘাটিতে যেতে পারে। কিন্তু সহযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে ফেরাতে পারলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে নূর মোহাম্মাদ নিস্তেজ হয়ে পড়েন। সেদিন তার আত্মত্যাগ হয়ে ছিল। শ’ শ’ সহযোদ্ধার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে ছিল সেদিন।
তাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয় যশোরের শার্শা উপজেলার উত্তর সীমান্তবর্তী কাশিপুর গ্রামে। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে ও তার মৃত্যু দিবসে ওই এলাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এসে তার স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে যান। ফুুল দেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
উপজেলা প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) এসব দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। গ্রামবাসী মিলাদ দেন প্রতি বছর। তারা গর্ববোধ করেন একজন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিসৌধ তাদের গ্রামে থাকার জন্য। নূর মোহাম্মাদ সহযোদ্ধারা একদিন দেশ স্বাধীন করল। কিন্তু নূর মোহাম্মাদ তা দেখে যেতে পারলেন না। তার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।
নূর মোহাম্মাদ স্মৃতি আজও তার সহযোদ্ধার বুকে গভীর নিশীথের করুণ আর্তনাদের মতো বাজে বাঙালির ইতিহাস চেতনায় তিনি সমুজ্জ্বল।