শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ২২ নভেম্বর ২০১৬
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে নজিরবিহীন মুসলিম নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সেখানে চলছে নির্বিচারে গণহত্যা। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর ত্রিমুখী নৃশংসতায় দিশেহারা রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা। তাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরীদের নির্যাতন-নির্মমতা ইতঃপূর্বেকার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বিভীষিকাময়।
অঞ্চলটিতে মগদের বাসস্থান হওয়ায় একে মগের মুল্লুকও বলা হয়ে থাকে। এখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তাদের ওপর নির্যাতন ঐতিহ্যগত। গত কয়েক দিনে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মুসলিম নিধনের ভয়াবহ চিত্র ইতোমধ্যে বিশ্ব মিডিয়াগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘসহ বৃহৎ দেশগুলোর অবস্থান গ্রহণের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এ দিকে রাখাইন রাজ্যের ঘটনায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, প্রবেশ রোধে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক রয়েছে। টেকনাফ সীমান্তে অতিরিক্ত ৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের খিয়াড়িপাড়া গ্রামের মো: ইসলাম (৭২) জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বাঁচার জন্য তিনি তার পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে সোমবার ভোরে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেন। তার অভিযোগ, নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই ব্যাপক যে, সে দেশে বর্তমানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেন জীবন্মৃত। আর যেসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে যে যে ভাবে যে দিকে পারে পালিয়েছে তারাও অনাহারে অর্ধাহারে ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে ও সীমান্ত ছাড়িয়ে আত্মরা করেছে। অনেকেই তাৎক্ষণিক হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে নৌকা নিয়ে সাগরে যাত্রা করেছে। সেখানেও নৌসেনাদের হাত থেকে রেহাই নেই। যারা কোনোমতে বেঁচে আছেন তারা সাগরে ঘুরতে ঘুরতে পানি ও খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছে।
নির্যাতিতরা অনেকেই মোবাইলে তাদের করুণ পরিণতির কথা ও ছবি তুলে জানাচ্ছেন। মংডুতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বসবাসরত আত্মীয়দের জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা শত শত রোহিঙ্গা পুরুষদের ধরে নিয়ে গেছে। এদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে অমানবিক। তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা জানা নেই। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন প্রদেশের মংডুর উত্তরে চলমান এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি গ্রাম নারী-পুরুষশূন্য হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। সাহায্য সংস্থাগুলোর প থেকে তাদের কাছে খাদ্যসামগ্রীও পৌঁছতে দেয়া হচ্ছে না। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে ধর্ষণ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার বিকেলে মংডুর উত্তরে কেয়ারিপ্রাং এলাকার তিন রোহিঙ্গা যুবতীকে ধর্ষণ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। ওই গ্রামের কাছাকাছি স্থান ধুদাইং এলাকার একটি পাড়া শনিবার বিকেলে ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। পরণে যুবতী-কিশোরীদের প্রত্যেককে একেকটি ঘরে প্রবেশে বাধ্য করে। মহিলারা ঘরে প্রবেশ না করে ভয়ে এক স্থানে একত্র হন। এদের মধ্যে থেকে ধুদাইং এলাকার হাজী করিমুল্লার মেয়ে ওয়াজেদা বেগমকে (১৭) নির্জন স্থানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। রোববার সকালে ওই কিশোরীর লাশ পাওয়া যায়।
সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সেনাসদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রা করতে পাহাড়ের পাদদেশে বা লবণের মাঠে নিজেদের ব্যবহৃত কাপড়ের তাঁবু গেড়েছে। যেসব রোহিঙ্গা পরিবার পুরনো বসতভিটা ছেড়ে যায়নি, তাদের বাড়িঘরে গিয়ে তল্লাশির নামে সেনাসদস্যরা ঘর ও দোকানের মূল্যবান মালামাল লুট করার পাশাপাশি গৃহপালিত গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মংডুর উত্তরে হাতিরপাড়া, নাইছাপ্রাং, কেয়ারিপ্রাং, ধুদাইং, জাম্বুনিয়া, গৌজুবিল, রাম্ম্যাউবিল, কুজাবিল, রাহবাইল্যা, বুড়াসিকদারপাড়া, লংডুং ও বলিবাজার এবং রাচিদং জেলার মেরুংলোয়া, ধুংছে, ওয়াস্যং, রড়ছড়া, আন্দাং, কেয়ান্দং এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে বেশি। ওইসব এলাকায় শুক্রবার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ আদায় করতে বেশির ভাগ রোহিঙ্গাকে যেতে দেয়া হয়নি।
সেনাসদস্যরা বৃহস্পতিবার থেকে দেশটির রাখাইন যুবকদের সামরিক প্রশিণ বা ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরো বেশি ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনুরূপ প্রশিণ দেয়া হচ্ছে বৌদ্ধ ভিুদেরর।
রোববার পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে চিরুনি অভিযান চলছে এতে প্রায় ৩০ হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা পুরুষ ও যুবককে। প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলিম। ধর্ষিত হয়েছে অসংখ্য নারী। এখনো রাখাইন প্রদেশের মংডুতে দিনে-রাতে জারিকৃত কার্ফ্যু অব্যাহত রয়েছে। রাখাইন প্রদেশের মংডু জেলার উত্তরে ঘটনার ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রায় সাত দশক আগে থেকে সাবেক আরাকান (বর্তমান রাখাইন) প্রদেশে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। নানা অজুহাতে ছলচাতুরিতে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরীরা বারবার হামলে পড়ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। বর্বর-অমানবিকতার সব রেকর্ড ছাড়ানোর কথা ইতোমেধ্য বিশ্বজুড়ে আলোচিত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে, অনুরোধও জানানো হয়েছে জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী সরকারের প থেকে; কিন্তু মিয়ানমার সরকার উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা ও অনুরোধকে উপোই করে চলেছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষত ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জারিকৃত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়। (১) তাইরেন্স (প্রথম শ্রেণীর নাগরিক) (২) নাইংচা (প্রাকৃতিক নাগরিক) (৩) নাইংক্রাচা (অথিতি নাগরিক); কিন্তু এই তিন ক্যাটাগরির কোনো একটিতে রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্ব স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তাদের কাছে এখন যে কার্ড (পরিচয়পত্র) আছে তার ওপর লেখা রয়েছে বাঙালি লুমিউ অর্থাৎ (বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত)। এ ঘোষণার ফলে রোহিঙ্গাদের কারো কাছে নাগারিকত্ব কার্ড না থাকায় রোহিঙ্গারা দেশবিহীন জাতিতে পরিণত হয়। এই পর্যন্ত ১৯ বার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন অভিযান চালায় মিয়ানমারের বিভিন্ন বাহিনী। এসব অভিযানের ল্যই ছিল রোহিঙ্গাদের স্বদেশভূমি থেকে বিতাড়িত করা। সর্বশেষ ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে হামলার অভিযোগে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাচ্যুৎ করার এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা হাতে নেয় সে দেশের সরকার।