শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ৪ ডিসেম্বর ২০১৬
বোয়িং চেকলিস্টে অয়েল প্রেসার সিস্টেমে কোনো কাজ ছিল না * অয়েল প্রেসার সিস্টেম স্ক্যানিং করে আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হবে
ভিভিআইপি চেকলিস্টে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজের অয়েল প্রেসার সিস্টেমে সেদিন কোনো ধরনের কাজ করার কথা ছিল না। বোয়িং কোম্পানির চেকলিস্ট অনুযায়ী ওইদিন অয়েল প্রেসার সিস্টেমসংলগ্ন ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমে কাজ করেছিল বিমানের অ্যারোনটিক্যাল প্রকৌশলীরা। এ অবস্থায় নাট ঢিলে হওয়া নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে কাজ করার সময় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কেউ ওই নাট বোল্টে হাত দিয়েছিল। এ কারণে গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে পুরো অয়েল প্রেসার সিস্টেম স্ক্যানিং করে সেখানে কোনো ধরনের আঙুলের ছাপ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা শুরু করেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ থেকেই বেরিয়ে আসবে পুরো রহস্য। তাদের বক্তব্য, যেহেতু বোয়িং কোম্পানি চেকলিস্ট অনুযায়ী উড়োজাহাজের ওই অংশে কোনো ধরনের কাজ ছিল না, সেহেতু কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওই নাটটি ঢিলে করে দিতে পারে। এটিই এখন তদন্তের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
অপরদিকে পাকিস্তানের লাহোর পার হওয়ার পর বিমানের ককপিট মনিটরে অয়েল প্রেসার (লুব্রিকেন্ট) কমে যাওয়ার মেসেজ আসে। একই সঙ্গে এ সময় কী ধরনের কাজ করতে হবে তারও একটি চেকলিস্ট মেসেজ আকারে মনিটরে ভেসে উঠে। কিন্তু বিমানের ককপিটে থাকা দুই পাইলট, দুই ফার্স্ট অফিসার ও কেবিনে থাকা পজিশনিং পাইলট ক্যাপ্টেন জামিল আহমেদ ওই চেকলিস্ট অনুযায়ী কাজ করেননি। উল্টো তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো উড়োজাহাজটি তুর্কমেনিস্তানের আসগরবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যান। এছাড়া পাইলটরা চেকলিস্ট অনুযায়ী ত্রুটিজনিত ইঞ্জিনটি শাটডাউন না করে আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা ঝুঁকিপূর্ণভাবে আকাশে উড়িয়েছে। বিমানের এফডিএমের (ফ্লাইট ডাটা মনিটর) দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি এ তথ্য পেয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর ওই ফ্লাইটটি নিয়ে কমপক্ষে তিন দফা বোয়িং কোম্পানির চেকলিস্ট অমান্য করা হয়েছে। তারা এখন এ তিনটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন- কেন এবং কি কারণে সংশ্লিষ্টরা এসব চেকলিস্ট অমান্য করেছে। তদন্ত কর্মকর্তারাই এ বিষয়ে ফ্লাইটে থাকা পাইলট, ফার্স্ট অফিসার, প্রকৌশলী ও বিমানের হ্যাঙ্গারের দায়িত্বে থাকা অ্যারোনটিক্যাল ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাদের ধারণা, এর উত্তর বেরিয়ে এলেই বোঝা যাবে, এটা কি স্যাবোটাজ নাকি অন্যকিছু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, ৫ বছর আগে আনা পালকি ও অরুণ আলোর অয়েল প্রেসার সিস্টেমের নাট-বোল্ট কখনও ঢিলে হয়নি। এখনও সেই আগের মতোই আছে। বোয়িংয়ের চেকলিস্ট অনুযায়ী ৩ বছর পরে (সি চেক) বোয়িং মনোনীত ওয়ার্কশপে গিয়ে ওই লুব্রিকেন্ট নাট খুলতে হয়। অথচ মাত্র ২ বছর আগে আনা সর্বশেষ বোয়িং রাঙ্গাপ্রভাতের নাট কেন ঢিলে হবে সেটা রহস্যজনক।
বিমানের প্রকৌশলীরা বলেছেন, বোয়িং ৭৭৭ রাঙ্গাপ্রভাতের মতো একটা ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজের নাট কেন লুজ বা ঢিলা হল এটা ভাবিয়ে তুলেছে বিমানের শীর্ষ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের। অয়েল প্রেসার সিস্টেমে নাট লুজ বা ঢিলা হওয়ার কোনো কারণই নেই। এ নাটে হাত দেয়ারই প্রয়োজন পড়ে না। ঘটনার পর বিমান থেকে বোয়িং কোম্পানিকে এটা জানানোর পর সেখানকার বিশেষজ্ঞরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষায়, অয়েল প্রেসার সিস্টেমের নাটে কোনো ধরনের সংস্কার, ঘষামাজা বা মেরামত করার মতো কোনো কাজ থাকে না। সাধারণত এ নাটে কোনো ধরনের সাইক্লিং আওয়ারও থাকে না। অন্যান্য ইউনিটের নাট-বল্টু বা যন্ত্রাংশের সাইক্লিং আওয়ার থাকায় একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর সেগুলো বদলানো বা রিপ্লেসমেন্ট করাটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ নাটের বেলায় তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। এ জন্যই উড়োজাহাজ নির্মাণের পর ৩ বছর এ নাটে কোনো ধরনের স্পর্শ ছাড়াই স্বাভাবিক থাকে। অথচ বিমানে রাঙ্গাপ্রভাত যুক্ত হওয়ার মাত্র ২ বছরের মাথায় এ নাট কেন লুজ হয়ে পড়েছে সেটারই হিসাব মেলাতে পারছেন না বিমানের প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গাপ্রভাতে অয়েল প্রেসার কমে যাওয়ার পর মেসেজে আসা ইলেট্রিক্যাল চেকলিস্ট অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ইসমাইল সেদিন কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা এখনও বিমান কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করছে না। এ নিয়ে বিমানের শীর্ষ পর্যায়ে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়কেও এ নিয়ে কোনো তথ্য দিচ্ছে না বিমানের ফ্লাইট অপারেশন। বিমানের নিজস্ব ও প্রথম তদন্ত প্রতিবেদনে ককপিট নিয়ে কোনো তদন্তই করা হয়নি। এ বিষয়টি পুরোটাই গোপন করে গেছে ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ গঠিত বিমানের তদন্ত কমিটি। বিমানের একজন ক্যাপ্টেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ক্যাপ্টেন ককপিটে তার সামনের মনিটরেই সব কিছু দেখতে পান। এ সময় ইলেকট্রিক্যাল চেকলিস্টেই ভেসে ওঠে পরবর্তী করণীয়। পাইলটরা সে অনুযায়ীই পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। তার মতে, এ ধরনের ত্রুটিজনিত কারণে নিয়মানুযায়ী প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ইঞ্জিন শাট ডাউন করা। এজন্য পাইলটকে তিনটি কাজ করতে হয়। এরপর এপিইউ (অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট) চালু করা। এরপর চেকলিস্ট অনুযায়ী মে-ডে, মে-ডে, মে-ডে কিংবা প্যান প্যান, প্যান প্যান বলে কন্ট্রোল সিস্টেমকে সিগন্যাল দেয়া। এই সিগন্যাল পেলেই আশপাশে থাকা অন্য এয়ারক্রাফট ও আশপাশের বিমানবন্দরগুলো ওই ফ্লাইটকে জরুরি অবতরণের জন্য জায়গা করে দেবে। কিন্তু ফ্লাইট ডাটা বক্সের তথ্য অনুযায়ী, পাইলট ককপিটে সেদিন এর কিছুই করেননি। উল্টো সাধারণ নিয়মানুযায়ী তুর্কমেনিস্তানের ওই বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারে যোগাযোগ করে অবতরণের অনুমতি চান। যেহেতু ওই বিমানবন্দরে তেমন ফ্লাইট থাকে না সেজন্য ওই মুহূর্তে তারা অবতরণের অনুমতিও পেয়ে যান। কিন্তু যদি কোনো কারণে ওই বিমানবন্দরে ওই মুহূর্তে অবতরণের অনুমতি না থাকত তাহলে শেষ মুহূর্তে বড় বিপর্যয়ের আশংকা ছিল। কারণ যখন অয়েল প্রেসার রেড সিগন্যাল দিচ্ছিল তখন বিমানটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ হাজার ফুট উপরে ছিল। ওই সময় বাম ইঞ্জিনের ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তুর্কমেনিস্তানে অবতরণের ১২ থেকে ১৫ মিনিট আগে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনায় ইঞ্জিন শাট ডাউন না করে অবতরণ করলে লোহার সঙ্গে লোহার ঘর্ষণে যে কোনো মুহূর্তে আগুন ধরে যাওয়ার আশংকা থাকে।
জানা গেছে, ঘটনার দিন তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিকভাবে একটি ব্রিফ দেয়া হয়। বলা হয়, এ ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আকাশপথে এ ধরনের ঘটনা হতেই পারে। বিমান প্রকৌশল শাখার প্রধান প্রকৌশলী দেবেশ চৌধুরী নিজে তখন ব্যাখ্যা দেন, কেন অয়েল প্রেসার কমে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে এয়ারক্রাফটের ফিটনেসসংক্রান্ত পাইলটের অনুমোদন লাগে। এ ধরনের অনুমোদন দেয়ার আগে পাইলটরা এয়ারক্রাফটের বাইরের অংশ ও দুই ইঞ্জিন ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। এ সময় তারা গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্টের গাড়িগুলো দিয়ে ইঞ্জিনের বাইরের অংশগুলোতে থাকা নাট-বোল্টগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। এ সময় কোনো ধরনের লিকেজ আছে কিনা পাখা থেকে তেল জাতীয় কোনো দ্রব্য ঘামাচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখেন। জানা গেছে, ওইদিন ফ্লাইট উড্ডয়নের অনুমোদন দেয়ার আগে দুই পাইলট কি ধরনের কাজ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সে বিষয়ে লগ বইতে কোনো ধরনের তথ্য পায়নি তদন্ত সংস্থা। জানা গেছে, বিমানের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন ক্যাপ্টেন ইসমাইল ও ক্যাপ্টেন আমিনুল। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণেই দুই বন্ধুকে রক্ষা করার জন্য তারা তাদের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তড়িঘড়ি করে নিু শ্রেণীর ছয় কর্মকর্তাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন।