প্রশাসনে রদবদল আসছে

শীর্ষরিপোর্ট ডটকম। ৮ অক্টোবর ২০১৫

বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞাকে । এতে প্রশাসনের সবচে’ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ এ পদটি খালি হতে যাচ্ছে। এছাড়া চলতি মাসে আরো চারজন সচিব অবসরে যাচ্ছেন। আগামী মাসে অবসরে যাবেন শিক্ষা সচিবসহ আরো তিনজন সচিব। আগামী মাস অর্থাৎ নভেম্বরের তিনজন বাদ দিলেও শুধু চলতি মাসে ৫টি সচিব পদ খালি হচ্ছে। আর একে ঘিরে সবমিলিয়ে জনপ্রশাসনের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বড় ধরনের রদবদলের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে আছেন এখন সাবেক অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক। মেয়াদ শেষের কারণে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তার ঢাকা ফিরে আসার কথা ছিলো। কিন্তু, ফান্ড মিটিং নামে বিশ্বব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে অক্টোবরে। এই সময়ে নতুন একজন কাজে যোগ দিয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না। আর তাই ড. তারেকের সময় বাড়িয়ে অক্টোবর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা এ পদে যোগ দেবেন নভেম্বরের শুরু থেকে। এদিকে মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার চাকরির বয়স শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ডিসেম্বর। কিন্তু, বিশ্বব্যাংকের এ পদটি ৩ বছরের জন্য নির্ধারিত। ফলে তিনি বাকি ২ বছর সাড়ে ১০ মাস চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আলাদা এক আদেশ জারি করা হবে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহি পরিচালক পদে পদায়নের সার-সংক্ষেপ ইতিমধ্যেই অনুমোদিত হয়ে আছে। বাকি আছে শুধু আদেশ জারি।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক এই পদটিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন বর্তমান অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ। আগামী ২৯ ডিসেম্বর তার চাকরির বয়স শেষ হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিব মাহবুব আহমেদকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগের জন্য গত জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মৌখিক সুপারিশও করেছিলেন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী তা নাকোচ করেন এবং তখনই অর্থমন্ত্রীকে সরাসরি জানিয়ে দেন যে, এ পদটি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে, মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হচ্ছেন। তারপর জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞাকে বিশ্বব্যাংকে নিয়োগের জন্য একটি সার-সংক্ষেপ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তৈরি করে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত ২২ জুলাই এই সার-সংক্ষেপ অনুমোদন করেন। এরপর রেওয়াজ অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয় এটির ক্লিয়ারেন্সের জন্য। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকে ক্লিয়ারেন্সও এসেছে। এখন বাকি শুধু প্রজ্ঞাপন জারি।

বর্তমানে যিনি আছেন, মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ২০তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তারপর অর্থাৎ ২১তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব কে হবেন এ নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা চলছে গত বেশ কিছুদিন ধরেই। এ পর্যন্ত ৫ জনের নাম আলোচনায় এসেছে এই পদের জন্য। তারমধ্যে সবচে’ বেশি আলোচনা হচ্ছে বর্তমান মুখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ ও ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর নাম। এছাড়া আরো তিনজন হলেন, স্বরাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক খান, ভূমি সচিব মোহাম্মদ সফিউল আলম এবং বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন।

এটা প্রায় সবাই জানেন, মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত কাছের। সরকারের নানাবিধ কাজকর্মসহ অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই প্রধানমন্ত্রী তার উপর নির্ভর করে থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দূরে সরাবেন কিনা এ নিয়ে কারো কারো সন্দেহ রয়েছে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে ড. কামাল কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আবুল কালাম আজাদ অথবা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী- এই দু’জনের মধ্য থেকেই পরবর্তী মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ দেয়া হবে, এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

অবশ্য আবুল কালাম আজাদের চাকরির বয়স শেষ হচ্ছে আগামী ৬ জানুয়ারি। তাকে এখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হলে সেই পদে তাকে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন হবে। যা এক ধরনের সমস্যাই বটে। তথাপি আবুল কালাম আজাদকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হলে মুখ্যসচিব পদে নিয়োগ পেতে পারেন ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অন্যদিকে ড. কামাল আবদুল নাসের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হলেও জনপ্রশাসন সচিব পদটি খালি হচ্ছে। এ কারণে জনপ্রশাসন সচিব কে হবেন এটাও এ মুহূর্তে আলোচনায় আসছে। এক্ষেত্রে আলোচিত হচ্ছে স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান, বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, জ্বালানি সচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক, পূর্তসচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নাম। পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে সরানোর সম্ভাবনা খুব কম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও মোজাম্মেল হক খান পুলিশ বিভাগের বেশ পছন্দের বলে পরিচিতি পেয়েছেন।

তবে এছাড়াও চলতি মাসে আরো চারজন সচিবের চাকরির বয়স শেষ হচ্ছে। এদের মধ্যে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. সেলিনা আফরোজ ৮ অক্টোবর, স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সদস্য পরীক্ষিত দত্ত চৌধুরী ২১ অক্টোবর এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লা ৩১ অক্টোবর অবসরে যাবেন বলে নির্ধারিত রয়েছে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব পদেও পরিবর্তন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। সচিব মো. মাকসুদুল হাসান খানের সঙ্গে দুদক কমিশনারদের বনিবনা হচ্ছে না প্রায় শুরু থেকেই। অবশেষে মাকসুদুল হাসানকে সেখান থেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তাকে কোথায় দেয়া হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

জানা গেছে, পাট ও বস্ত্র সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী তার বর্তমান পদে সন্তুষ্ট নন। তিনি অন্য যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা বড় মন্ত্রণালয় চাচ্ছেন। মৎস্য ও পশুসম্পদ সচিব পদে তাকে দেয়ার বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত হয়ে আছে। কিন্তু, তিনি সেখানেও যেতে আগ্রহী নন।

এদিকে স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তার পক্ষ হয়ে স্বাস্থ্য খাতের সেই অতি পরিচিত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটটি তদবির করছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সিন্ডিকেটটির হাত অনেক লম্বা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সফরের সময় প্রায় শেষ মুহূর্তে এই মহলটি তদবির চালিয়ে সৈয়দ মনজুরুলের নাম সফরসঙ্গীর তালিকায় উঠাতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তাকে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য তদবির চালাচ্ছে ওই সিন্ডিকেটটি, পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেরও চেষ্টা চলছে। উল্লেখ্য, স্বাস্থ্যসচিব হিসেবে তিনি এদেরকে ব্যাপকহারে লুটপাটের সুবিধা করে দিয়েছিলেন। নিজেও মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসান ইতিমধ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তার দুর্নীতির নিয়ে হজ ক্যাম্প এলাকায় হজযাত্রীরা মিছিলও করেছে। মিছিলকারীদের দাবি ছিলো, ধর্মসচিবের অপসারণ ও শাস্তি। এদিকে মন্ত্রীর সঙ্গেও তার বনিবনা হচ্ছে না। যে কারণে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে চৌধুরী বাবুল হাসানের বদলিও অনেকটা অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব পদে আছেন রাষ্ট্রপতির ১০% কোটায় নিয়োজিত ট্যাক্স ক্যাডারের কর্মকর্তা কাদের সরকার। বর্তমান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের তার তেমন একটা বনিবনা হচ্ছে না। কাদের সরকার নিজেও এখানে থাকতে তেমন একটা আগ্রহী নন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা ছিলো তার। এদিকে এ পদটি পেতে আগ্রহী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য, কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিনও। যদিও এনবিআর’র বর্তমান চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানকে এ পদ থেকে সরানোর কোনো ইচ্ছা সরকারের এ মুহূর্তে নেই, তারপরও তাকে সরানোর জন্য রাজস্ব বোর্ডেরই একটি গ্রুপ নানামুখী চেষ্টা আব্যাহত রেখেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

 

Related posts