শীর্ষরিপো্র্ট ডটকম । ১০ ডিসেম্বর ২০১৬
বিশ্বে বর্তমানে জরায়ু মুখে ক্যান্সার নারীমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। দক্ষিণ এশিয়া জরায়ু মুখে ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের শতকরা ৩০ জনই জরায়ু মুুখ ক্যান্সারের শিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ নারীদের মধ্যে ২৯.৪ জন জরায়ু মুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিবছর এ দেশে প্রায় ১২ হাজার নারী নতুনভাবে জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
জরায়ু মুখের কোষগুলোর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে জরায়ু মুখে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। এ পরিবর্তন একদিনে হয় না।
জরায়ু মুখের স্বাভাবিক কোষগুলো বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। জরায়ু মুখে অনেকদিন ধরে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা থাকতে পারে যা সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা খালি চোখে দেখা যায় না।
কারণ
জরায়ু মুখে ক্যান্সার দুই বয়সে বেশি দেখা দেয়- ৩৫ বছর এবং ৫০-৫৫ বছর। এ ক্যান্সারের কোনো সুনির্দিষ্ট একক কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (HPV) জরায়ু মুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা হয় যা কেবলমাত্র অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জরায়ু মুখে সংক্রমিত হয়ে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। এ পর্যন্ত ১৩০ ধরনের ঐচঠ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে HPV ১৬, HPV ১৮ প্রজাতি শতকরা ৭০-৮০ ভাগ জরায়ু মুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
যাদের হওয়ার আশংকা বেশী
* নিরাপদ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
* বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ
* অধিক ও স্বল্প বিরতিতে গর্ভধারণ
* বহুগামিতা
* অনেকদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খেলে
* ধূমপান করলে
লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ু মুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও ধীরে ধরে নিন্মলিখিত উপসর্গ দেখা দেয়
* যোনিপথে অতিরিক্ত সাদা স্রাব
* বাদামি/ রক্তমিশ্রিত স্রাবের আধিক্য
* অনিয়মিত রক্তস্রাব
* সহবাসের পর রক্তক্ষরণ
* ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রক্তক্ষরণ
* তলপেটে/ কোমরে ব্যথা।
ক্যান্সারের পূর্ববর্তী অবস্থা শণাক্তকরণ
জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কিছু ঝপৎববহরহম পরীক্ষার মাধ্যমে (VIA, PAPS Smear, Colposcopy, HPV DNA) জরায়ু মুখে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা শনাক্ত করা সম্ভব।
সারা বিশ্বে PAP Smear জরায়ু মুখের ক্যান্সার Screening এর জন্য gold standard প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে VIA’র মতো সহজলভ্য (Visual Inspection of Cervix with 5% acetic acid) পদ্ধতিকে জাতীয় পর্যায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। VIA/PAPS এর মাধ্যমে জরায়ু মুখে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা শনাক্ত হবার পর Colpocopy’র সাহায্যে বায়োপসি নিয়ে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা নিশ্চিত হয়ে সহজ চিকিৎসা গ্রহণ করলে শতভাগ রোগ নিরাময় সম্ভব। আবার খালি চোখে জরায়ু মুখ পরীক্ষা করে কোনো growth, ulcer পাওয়া গেলে সেখান থেকে বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
কোন বয়সে এ ক্যান্সারের Screening করা প্রয়োজন
জরায়ু মুখ ক্যান্সারমুক্ত রাখতে হলে ৩০-৬০ বছরের নারীদের প্রতি ৩ বছর পরপর VIA-র সাহায্যে জরায়ু মুখ পরীক্ষা করাতে হবে। ১৮ বছরের আগে বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ২৫ বছর হলেই জরায়ু মুখ পরীক্ষা করাতে হবে। আবার বিয়ের বয়স ১০ বছরের অধিক হলে সে ক্ষেত্রে ৩০ বছরের কম বয়স হলেও জরায়ু মুখ পরীক্ষা করাতে হবে।
কোথায় ঠওঅ পরীক্ষা করা হয়
* নির্বাচিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র
* নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
* জেলা সদর হাসপাতাল
* সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
* জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল
* বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে Clinical staging করে জরায়ু মুখ ক্যান্সারের বিস্তৃতি অনুধাবন করা হয় এবং সেই সঙ্গে জরায়ু মুখ থেকে বায়োপসি নিয়ে histopathological grading করা হয়। Clinical staging ও histopathological grading এর ওপর ভিত্তি করে জরায়ু মুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।
Stage I : যখন ক্যান্সার শুধু জরায়ু মুখে সীমাবদ্ধ থাকে
Stage II : যখন ক্যান্সার জরায়ু মুখের সঙ্গে যোনিপথের ওপরে কিছুটা ছড়ায়
Stage III : যখন ক্যান্সার জরায়ু মুখের সঙ্গে যোনিপথের নিচের অংশে ও আশপাশে কিছুটা ছড়ায়
Stage IV : যখন ক্যান্সার জরায়ু মুখের সঙ্গে মূত্রথলি, মলদ্বার অথবা দূরে লিভার, ফুসফুস, ব্রেইনে ছড়িয়ে যায়।
জরায়ু মুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা Multidisciplinery Approach এ দেয়া হয়। জরায়ু মুখ ক্যান্সারের প্রতিটি stage এ রেডিওথেরাপি দেয়া যায়। তবে Stage I ও stage II এর প্রাথমিক অবস্থায় অপারেশনের মাধ্যমে রোগ নিরাময় সম্ভব। আর Advance stage এ কেমো-রেডিয়েশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
জরায়ু মুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার পরও নির্দিষ্ট বিরতিতে রোগীকে সারা জীবন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।
প্রতিরোধ
জরায়ু মুখে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। জরায়ু মুখ ক্যান্সারমুক্ত রাখতে চাইলে
* নারীদের শিক্ষিত হয়ে নিরাপদ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে
* বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে
* অধিক সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
* সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে
* ৩০-৬০ বছরের সব নারীদের জরায়ু মুখের ক্যান্সার Screening কর্মসূচির আওতাধীন থেকে প্রতি ৩ বছর পরপর জরায়ু মুখ পরীক্ষা করাতে হবে
* বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বর্তমানে আমাদের দেশেও জরায়ু মুখের ক্যান্সারের প্রতিষেধক টিকা পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক : স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়